দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ভোটের তারিখ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার আর মাত্র সাত দিন বাকি থাকলেও বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আভাস মিলছে না। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে সংঘর্ষের পর থেকে দলের মহাসচিবসহ বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে। বিশেষ করে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা গুরুত্বপূর্ণ, তাদের অনেকে কারাগারে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও অনেকটা আত্মগোপনে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে দলটির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ জানালেও অনেক নেতার মধ্যে আবার ভোট নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ চলছে। তাই শেষ মুহূর্তে বিএনপি ভোটে অংশ নেবে কিনা এখনো সে আলোচনা চলছে।
বিজ্ঞাপন
৭ জানুয়ারিকে ভোটের তারিখ ধরে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ফরম বিক্রি করছে। ইতোমধ্যে কিছু আসনে প্রার্থীও চূড়ান্ত করেছে। অন্যদিনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখনো সরকারের পদত্যাগের আন্দোলনে রাজপথে আন্দোলন করছে। এমন পরিস্থিতিতে শেষ মুহূর্তে বিএনপি যদি ভোটে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তফসিল পরিবর্তন করার বিষয়টি ভেবে দেখবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
গত সোমবার নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানা বলেছেন বিএনপি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে প্রয়োজনে আইন দেখে ভোটের সময় বাড়ানোর বিষয়টি ভেবে দেখা হবে। এর একদিন পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক রেখে তফসিল পরিবর্তন করবে তাতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই।
তফসিল নিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীনদের এমন বক্তব্যের কারণে অনেকেই ধারণা করছেন পর্দার আড়ালে বিএনপির সঙ্গে কোনো কথাবার্তা চলছে কি না? মত বদলে শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না সেটিও নিয়ে নানা অনুমান তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
কী ভাবছে বিএনপি?
তফসিল সংক্রান্ত এসব কথাবার্তা খুব একটা আমলে নিচ্ছে না বিএনপি। তাদের ধারণা একটা 'বিভ্রান্তি তৈরি' করার জন্যই এসব কথা বলা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘মূল কথা হচ্ছে সরকারের কথায় মানুষের আস্থা নেই। তারা আজকে এক কথা বলছে, কালকে আরেক কথা বলছে। আজকে বিএনপিকে খুশি করার জন্য নির্বাচনী শিডিউল দুই দিন-পাঁচ দিন পিছিয়ে দেবে আর বিএনপি তাদের উল্টো-পাল্টা কথা আস্থায় নিয়ে লাফিয়ে নির্বাচনে যাবে- এটা মনে হয় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’
ভারতে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদও জোর দিয়ে বলছেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। এটা অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগ দুজনে দুজনার। তারা তফসিল আগাবে না পেছাবে এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। নির্বাচনে যাওয়ার মতো কোন সিদ্ধান্ত আমাদের দলের মধ্যে নাই।’
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির মধ্যে এখন কয়েকটি চিন্তাধারা কাজ কাজ করছে। দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে বলা কয়েকটি ধারণা পাওয়া যায়।
নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোন দিকে যায় সেটি তারা দেখার অপেক্ষায় আছেন। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, ক্ষমতাসীনরা একতরফা নির্বাচন করে ‘পার পাবে না’।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার এবং তাদের মুক্তি দিলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি ইতিবাচক হলেও হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘এটা ঠিক যে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। তারপরেও আমরা নির্বাচনে গিয়ে দেখতে পারি, পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। প্রয়োজনে মাঠ থেকে সরে আসব।’
কিন্তু এর বিরুদ্ধমতও আছে বিএনপিতে। অনেক নেতা মনে করেন, নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলে জনগণের কাছে বিএনপির বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হতে পারে। তাছাড়া একবার নির্বাচনের মাঠে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসাও সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি ২০১৮ সালের মতো হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
তাছাড়া নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার কিংবা জামিনের বিষয়টি সরকারের সঙ্গে আলোচনা বা সমঝোতার বিষয়বস্তু হতে পারে না বলে দলটির অনেক নেতা মনে করেন।
বিদেশে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা তো জামিনের জন্য আন্দোলন করি নাই। আমরা তো আন্দোলন করছি এদেশের মানুষের ভোটাধিকারের জন্য। এ অবস্থাতে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। প্রশাসন থেকে শুরু করে সবই তাদের কন্ট্রোলে। কেয়ারটেকার সরকার আসুক আমরা নির্বাচনে যাব, তাছাড়া আমরা নির্বাচনে যাব না।’
বিএনপি অনড় থাকবে?
বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে নির্বাচনের জন্য তারা প্রস্তুত নয়। অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় পুরনো মামলায় বিএনপি নেতাদের কারাদণ্ড হচ্ছে। এমন অবস্থায় তারা নির্বাচনের চেয়ে মামলা মোকাবেলা কিংবা গ্রেফতার এড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে দাবি করা হচ্ছে, গত ২৮শে অক্টোবরের পর থেকে সারাদেশে দলটির ১৫হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে।
তাহলে এখনকার পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না – এটাই কী চূড়ান্ত কথা?
জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, ‘চূড়ান্ত কথা বলে রাজনীতিতে কিছু নেই। রাজনীতি হচ্ছে একটা ফ্লেক্সিবল জিনিস। এবং গিভ এন্ড টেইকের ভিত্তিতে রাজনীতি পরিচালিত হয়। কাজেই এখানে আমি আমার গো ধরে বসে থাকব, সরকার তার গো ধরে বসে থাকবে – এটা তো কথা হতে পারে না। তবে সরকারকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই মনে করেন নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে চাপ তৈরি হয়েছে সেটি বিএনপির জন্য ইতিবাচক। কিন্তু তারা আন্দোলন থেকে সরে আসার কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করছি গত ১৫ বছর ধরে। এখানে হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি হয়তো সহায়ক ভূমিকা হিসেবে আছে। কিন্তু আমরা শুধুমাত্র তার ওপর নির্ভরশীল নই। আমরা দেশের মানুষকে নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তুলছি।’
বিএনপি নেতারা স্বীকার করছেন, সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন তফসিল পেছানো সংক্রান্ত যে বক্তব্য দিয়েছে সেটিতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য দুই-একদিনের মধ্যেই নির্বাচন সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানান স্থায়ী কমিটির এক সদস্য।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমআর