গত তিনটি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জোটের মাধ্যমে ভোট করে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ এবার কিছুটা ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। সরাসরি জোটকে নাকচও করছে না, আবার কার্যত জোটকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলীয় জোটের অন্যান্য শরিকদের ছাড় দেওয়া আসনগুলোতেও প্রার্থী ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন দল। আবার জাতীয় পার্টিও ২৮৯টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আওয়ামী লীগ এবার জোট নিয়ে কী কৌশল অবলম্বন করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়?
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সূত্রে জানা গেছে, দলটি অপেক্ষা করছে বিএনপির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে না এলে তাদের জোট কৌশল হবে একরকম। আবার বিএনপি কোনোভাবে নির্বাচনে চলে এলে তাদের কৌশল হবে ভিন্ন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ভোটে এলে আওয়ামী লীগ আঁটঘাট বেঁধে জোট নিয়ে নামবে। আর বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় অটল থাকলে জোটের ব্যাপারে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে না। অনেকটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যারা বিজয়ী হতে পারেন হবেন। এমনকি দলীয় নেতাদেরও সেই নির্দেশনা দেওয় হয়েছে।
গত শনিবার (২৫ নভেম্বর) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জোটের ব্যাপারে দলীয় অবস্থানের কথা জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘শরিকদের আমাদের প্রয়োজন আছে কি না, সেটা এখনো ঠিক করিনি। কারণ, জোটের বিপরীতে জোট হবে। এখানে আমাদের প্রতিপক্ষ যদি একটা বড় জোট করে, সেখানে তার বিপরীতে আমাদের জোট হবে, তা ছাড়া আমাদের কেন অহেতুক জোট করতে হবে? প্রয়োজন না থাকলে তো জোট করব না। আর জোট করব যাদের নিয়ে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা তো মানুষের কাছে থাকতে হবে।’
তবে ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যে কিছুটা ক্ষুব্ধ শরিকরা। অনেকটা অভিমানের সুরে শরিক দলের নেতারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনে জোটগত নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। এখন যদি তারা বাদ দেয়, সেটা দিতেই পারে। এতে কিছু করার নেই। যদিও তারা এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগ যে এবার জোটকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে না সেটা গতকাল রোববার (২৬ নভেম্বর) প্রার্থী তালিকা ঘোষণার মাধ্যমে অনেকটা প্রকাশ পেয়েছে। দলটি ২৯৮টি আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। একমাত্র জোটের শরিক হাসানুল হক ইনু এবং জাতীয় পার্টির নেতা সেলিম ওসমানের আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। রাশেদ খান মেননসহ ১৪ দলীয় জোটের হেভিওয়েট প্রার্থীদের আসনেও নৌকার প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হলে জোটের সঙ্গে সমন্বয়ের সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সোমবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘২০০৮ সালে আমরা জোটবদ্ধ নির্বাচন করেছিলাম। সেবারও প্রায় ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। পরে মহাজোটের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছিল। গতবারও প্রায় সব আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, পরে জোটের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছিল। এবারও ২৯৮ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রথমেই বলেছি, জোটবদ্ধ নির্বাচন করব। সেটি কিন্তু দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। মনোনয়ন দিলেও জোটের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। কোন জায়গায় কীভাবে হবে সেটি যেহেতু ঠিক করা হয়নি, সে জন্য সব আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এবং পরে জোটের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জোট প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সোমবার বিবিসিকে বলেন, ‘জোটের বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনো দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি। আমাদের হাতে যেহেতু এখনো সময় আছে, কাজেই প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত এটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না।’
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমাদের হাতে এখনো সময় আছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনো চিন্তা-ভাবনা করছি। সবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া শেষ হোক, তারপর এটা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
তবে গত দুই নির্বাচনের মতো আগামী জাতীয় নির্বাচনেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভোট করার আশা করছে ১৪ দলের শরিক দলগুলো। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের এই জোট গঠন করেছেন শেখ হাসিনা। উনিই আমাদের জোট নেত্রী। তিনি ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত জোট থাকবে এবং আমরা জোটবদ্ধ হয়েই নির্বাচন করব। আসন চেয়ে আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের ১৩ জনের একটি তালিকা নেত্রীর কাছে পাঠিয়েছি। কতজনকে দেবেন, উনি বিবেচনা করবেন।’
জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, ‘কাদের সাহেব তার কথায় আসলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, আমরা বুঝিনি। জোটের সর্বশেষ মিটিংয়ে আমাদের বলা হয়েছে যে, বিএনপি নির্বাচনে আসুক কিংবা না আসুক, আমাদের জোট থাকবে।’
ইনু বলেন, ‘এবার দুই ধরনের নির্বাচনী কৌশল নেওয়া হতে পারে বলে আমার ধারণা। প্রথমটি হচ্ছে, আগের মতোই জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করা, যেখানে আমরা সবাই নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করব। আরেকটি হচ্ছে, কিছু আসন উন্মুক্ত রাখা যেখানে জোটভুক্ত দল তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করবে। কৌশল যেটাই নেওয়া হোক, আমরা প্রস্তুত আছি।’
বর্তমান জাতীয় সংসদে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের আটজন সংসদ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের প্রতি দলের তিনজন করে, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরীকত ফেডারেশনের একজন করে সংসদ সদস্য রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সূচনা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের কারণে এক তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালে জোটে জাতীয় পার্টি না থাকলেও নানাভাবে তাদের ছাড় দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি ছাড় পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ১৪ দলের অন্যান্য শরিকরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন।
জেবি