শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫২ পিএম

শেয়ার করুন:

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মানুষের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজার অস্থিতিশীল। সব ধরনের জিনিসের বাড়তি দামের মধ্যে আবারও নির্বাহী আদেশ। এই আদেশে বিদ্যুতের পর এবার বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম। মাত্র ১ মাসের ব্যবধানে দুটি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সেবামূলক পণ্যের দাম বাড়ানো নিয়ে সর্বত্র বইছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়।

এবার শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বাড়ালেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে কোনো ধরনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি জ্বালানি বিভাগ। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে শর্ত বাস্তবায়নে সরকার একের পর এক পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়াচ্ছে। ৭ মাসে ছয়বার বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল ও সারের দাম।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: নতুন বছরে সাধারণ মানুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ

এর প্রভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মান কমে যাচ্ছে। ব্যয়ভারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ায় দাম বাড়ছে সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট, স্মল পাওয়ার প্লান্ট ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র, কুটির ও অন্যান্য শিল্পে, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে।

গ্যাস সংকট নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। উৎপাদনের খরচ বাড়লেও শিল্প বাঁচাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হন ব্যবসায়ীরা। তবে তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা চান। আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও সমন্বয় করার ব্যাপারে নির্বাহী আদেশ চান। শেষমেশ আসল নির্বাহী আদেশ। কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ালেও সরকার শিল্প মালিকদের এই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কোনো ধরনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।

>> আরও পড়ুন: গৃহিনী থেকে লড়াকু চা দোকানি সুফিয়া খালা


বিজ্ঞাপন


ভোক্তা পর্যায়ে সবশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল গত বছরের ৪ জুন। ওই সময় গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সর্বশেষ সার উৎপাদনে ২৫৯ শতাংশ, শিল্পে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ (বৃহৎ শিল্পে ১১ দশমিক ৯৮ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১ দশমিক ৭৮ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০ দশমিক ৭৮ টাকা, চা শিল্পে ১১ দশমিক ৯৩ টাকা), বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছিল। এছাড়া আবাসিকে এক চুলার দাম ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়েছিল।

প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি দর ১২ দশমিক ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, সার উৎপাদনে ঘনমিটার ৪ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছিল। দাম বাড়িয়ে গ্যাস না দিলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে- এ কথা ব্যবসায়ীদের। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে বন্ধ হয়ে যাবে শত শত শিল্পকারখানা। বেকার হবেন হাজার হাজার শ্রমিক।

>> আরও পড়ুন: নতুন শিক্ষা পদ্ধতি ও জনগণের প্রত্যাশা

এই মুহূর্তে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলবে। একই সঙ্গে জ্বালানি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়, যেমন বীমা খরচ, ঝুঁকি ব্যয়, ব্যাংক সুদ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি মূল্য অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাবে। সে কারণে জুলাই, ২০২২ থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান উৎপাদন/সরবরাহ সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও শিল্পসহ সব খাতে গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে।

চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং রফতানিমুখী বিভিন্ন কলকারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে করণীয় সম্পর্কে সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ করা হয়। যেহেতু স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানিপূর্বক উক্ত বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে হবে, সে কারণে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

>> আরও পড়ুন: ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ও বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং

তবে, অন্যান্য ভোক্তা শ্রেণি যথা গৃহস্থালি, সিএনজি, চা-শিল্প (চা-বাগান) ও সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আবাসিকে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি। গ্যাসের সমন্বিত নতুন মূল্যহার বিল ফেব্রুয়ারি ২০২৩ থেকে কার্যকর হবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে এক লাফে ৩০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ, দাম বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। গ্যাস সংকট নিয়ে কয়েক মাস ধরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। উৎপাদনের খরচ বাড়লেও শিল্প বাঁচাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হন ব্যবসায়ীরা। তবে তারা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা চান। আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও সমন্বয় করার ব্যাপারে নির্বাহী আদেশ চান।

কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ালেও সরকার শিল্পমালিকদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কোনো ধরনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। আর এখন যে পরিমাণ দাম বাড়ানো হয়েছে তাতে শিল্প টিকিয়ে রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনিতেই গ্যাসের সরবরাহ নেই। সরবরাহ থাকলে চাপ থাকে না। তারপরে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি শিল্পকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে শিল্পকারখানা থেকে হোটেল শিল্পে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বন্ধ হবে শিল্প-কারখানা, বন্ধ হবে হোটেল। বেকার হবে শ্রমিক। একবারে তিনগুণ দাম বাড়ানো যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তাই শিল্পের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে ও অজস্র শ্রমিকদের রুটি-রুজির সংস্থানের কথা ভেবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ভেবে-চিন্তে নেওয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

জেএম/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর