শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

গৃহিনী থেকে লড়াকু চা দোকানি সুফিয়া খালা

আলমগীর স্বপন
প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

গৃহিনী থেকে লড়াকু চা দোকানি সুফিয়া খালা

খালা নামেই জানি খালাকে। কখনও তার নাম জানার চেষ্টা করিনি। হয়তো আমরা যারা তাকে চিনি, কারো বোধে এমন তাড়না জাগেনি কখনও। খালা নামের আড়ালে একটা আস্ত নাম, পরিচয় কেমন করে হাওয়া হয়ে গেলো-এমন প্রশ্ন আমাদের মাথায় কখনও, কেন আসেনি? অথচ কালু, নাজিম, বাঙালির নাম আমরা ঠিকই জানি। তাদের কারো খাবারের দোকান আছে, কেউ বেচতেন চা।  

আমরা তার নাম জানি আর না জানি-খালা নামের লড়াইটা থেমে থাকেনি। গৃহিনী থেকে হয়েছেন লড়াকু চায়ের দোকানওয়ালা। কবে, কোন দিনে কিংবা কোন বছরে খালা জাহাঙ্গীরনগরে বসত গড়েছেন, সংসার চালাতে চায়ের দোকান শুরু করেছেন, তাও আমরা জানার চেষ্টা করিনি। করব কিভাবে? আমরা তো গত ২২ বছর ধরে তার হাত দিয়ে গরম জলে চাপাতি মেশানো ‘চা’ খেয়েছি শুধু। কাপে চিনি মেশানোর টুং টাং আওয়াজই শুনেছি। সিগারেটে ফু দিয়ে, ধোঁয়া ছেড়ে তার দোকানের কাঠের বেঞ্চে বসে আড্ডায় মশগুল হয়েছি। হাতি ঘোড়া মেরেছি। বান্ধবীর গা ঘেঁষে, হাত মুঠো করে ওম নিয়েছি। উনুন ঠেলাই যার নিয়তি ছিল, কেন সেই খালা ঘোর পুরুষবাদি সমাজে, মানুষের ভরা মজলিসে চায়ের দোকানে বসতে বাধ্য হলো? সেই প্রশ্ন ক্যাম্পাসের রঙ্গীন দুনিয়ার প্রাক্তন ও বর্তমান বাসিন্দারা আমরা কজনইবা করেছি? কজনইবা জানি?


বিজ্ঞাপন


এসব প্রশ্নের ঘুরপাকের মাঝে, জানা-শোনার ২২ বছরে খালার নাম জেনেছি অবশেষে। সুফিয়া বেগম, আমার মায়ের নামে নাম। হয়তো ক্যাম্পাসের প্রাক্তন বর্তমানের অনেকের মায়ের নামের সাথে মিলে যাব খালার নাম। তবে যে জীবন পেরিয়েছেন, পার করছেন, সেই জীবনে খালা কিংবা হবিগঞ্জের এই সুফিয়া বেগমের এসবে কী কিছু আসে যায়?

sufia-khala

দিনমজুর স্বামী আতর আলী যখন ২৫ বছর আগে তার চেনা দুনিয়া ছিনতাই করে জীবিকার খোঁজে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছিলেন, তখন খালার মনে  হয়তো ছিলো, ‘খাওয়া পড়ায় টানাটানি এইবার হয়তো কিছুটা কমবে?’ গাছ-পাখির-হাওয়ার-গানের ক্যাম্পাসের নতুন দুনিয়ায় এসে  তার মনে শৈশব কৈশোরের হবিগঞ্জ কিছুটা হলেও কী সেই সময়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল? প্রথম বর্ষের কোনো ছাত্রীর মতোই রঙ্গীন হয়ে উঠেছিল কী তার সেই সবদিন? হলেও, সেই রঙ্গীন দুনিয়ায় আন্ধার নেমেছিলো দুই বছর পরই। ক্যাম্পাসের পুরোনো ট্রান্সপোর্টে আতর আলীর চায়ের দোকান জমে উঠলেও তিনি আর থাকতে পারেননি। এক বছরের মাথায় কী এক রোগ এসে আতর আলীকে সাত আসমানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় খালার কাছ থেকে। আচমকা সেই আঘাতে সংসার তছনছ হয়েছিলো, কমজোরি মনে আবারও ভয় ঢুকেছিলো তিনবেলা খাবারের চিন্তায়।

কিন্তু দমেননি খালা। চার সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লেও চায়ের দোকানের হাল ধরতে পিছপা হননি। সেই থেকে ২২ বছর কেতলীতে গরম পানির ভাপে ফুটিয়ে যাচ্ছেন তারই পৈত্রিক শহর হবিগঞ্জের কোনো চা বাগানের পাতা। সেই পাতার ধোঁয়া ওঠা বাষ্পে, খয়েরি রংয়ের গরম পানিতেই নতুন করে জীবন জাগিয়েছেন। বড় করেছেন চার সন্তানকে। তিন মেয়ের মধ্যে বিয়ে দিয়েছেন দু’জনের। এই সময়ে বড় হয়ে গেছে খালার সেই ছোট্ট ছেলেটাও। যে ক্যাম্পাসে খালার কেতলিতে চায়ের গরম ভাপ ওঠে, সেই ক্যাম্পাস থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর করেছে ছেলে জাহাঙ্গীর। ছোটখাটো চাকরিও পেয়েছে। 


বিজ্ঞাপন


এরপরও কী খালার সুদিন ফিরেছে? সেই চায়ের দোকান অবশ্য একটু বড় হয়েছে। চায়ের সাথে যোগ হয়েছে লেবু ও আমের শরবত। চিপস, চানাচুর, বিস্কুটের প্যাকেট দোকানকে আরেকটু রঙ্গীন করেছে। কিন্তু জীবনের লড়াইটা তার চলছেই। সেই লড়াইয়ে কখনও কখনও ক্লান্তি আসলেও থামতে চান না আমাদের খালা-সুফিয়া বেগম।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর