বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য জরুরি হলেও তার চেয়ে বেশি জরুরি নিরাপদ খাদ্য। নিরাপদ কিংবা অনিরাপদ তথা ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য ও পানীয় ভাবনা আজ বিশ্বব্যাপী দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে মানবজাতিকে। এ ভাবনা থেকে অর্থাৎ পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। হতে হবে কেমিক্যালমুক্ত খাবার। বাংলাদেশের মানুষ ভাজা-পোড়া বেশি পছন্দ করে। রাস্তাঘাটে, বাজারে কিংবা কোনো শপিং মলের সামনে ভাজা-পোড়ার পসরা বসে। যেমন- বেগুনি, আলুর চপ, সমোচা, সিংগাড়া, ঝালমুড়ি ইত্যাদি। এইসব খাবারগুলোতে মেশানো হয় এক ধরনের ক্যামিক্যাল। আবার খেজুর, আম, কলা, কাঁঠাল, কোরমা-কালিয়া, পোলাও, বিরিয়ানি ইত্যাদি খাবারের সঙ্গেও মেশানো হয় কেমিক্যাল। ফুটপাতে পসরা বসানো এইসব খাদ্য আমরা হর-হামেশাই খেয়ে থাকি। এইসব খাধ্য খেলে যে আমরা মারাত্বক অসুস্থ হতে পারি কিংবা এই সব খাদ্যের কারণে কঠিন রোগ হতে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। সেটা হোক উচ্চবিত্ত, নিু-মধ্যবিত্ত কিংবা গরিব। আমরা সবাই চাই নিরাপদ খাবার, কেমিক্যালমুক্ত খাবার, হোক সেটা কোনো উৎসব কিংবা উৎসবের পরে।
বিশ্বের অনেক দেশই বিশুদ্ধ এবং পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আসছে, যাতে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী খাবারের সঙ্গে কেমিক্যাল জাতীয় কোনো পদার্থ ব্যবহার করতে না পারে। বাংলাদেশেও নিরাপদ খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চালানো জরুরি। বাংলাদেশে খাদ্যের যে মান তাতে করে প্রবীণ ও নবীনরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগী সংখ্যা অকল্পনীয় হারে বেড়েছে। খাদ্যপণ্যে ভেজালের কারণেই দেশের মানুষের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন- ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি রোগ, কিডনি ফেইলিউর, লিভার সিরোসিস, হৃদযন্ত্রের অসুখ, চর্ম রোগ, হাঁপানি। আর এসব জটিল রোগ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
বিজ্ঞাপন
কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে আমাদের নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান, কর্তৃপক্ষের সার্বিক নজরদারির অভাব, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের অসাধু কর্মকাণ্ডে।
আমাদের দেশে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ফসলে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহার। একই সঙ্গে মজুতদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা খাদ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক তথা ফরমালিন, ক্যালসিয়াম, কার্বাইড, ইথোফেন, কীটনাশক, কাপড়ের রঙ, পোড়া তেল ও মবিলমিশ্রিত তেলসহ নানা ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপকরণ, হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক খাদ্যে মেশানো অন্যতম কারণ। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাদ্যেও নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। এমন কোনো খাদ্যপণ্য নেই যেখানে ভেজাল নেই। একে নিয়ন্ত্রণে আনতে খাদ্যকে নিরাপদ করতে হবে সর্বাগ্রে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখনই বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, নিরাপদ খাদ্য সংস্থাসহ অন্যান্য সংগঠনের সহযোগিতায় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অন্যান্য খাদ্যে ভেজাল ও বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগকারী খাদ্য সন্ত্রাসীদের শাস্তির দাবি, ভেজাল রোধে জনসচেতনতা তৈরি, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সব ধাপে নজরদারি, ভেজালবিরোধী আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি একান্ত জরুরি। এছাড়াও যথেচ্ছভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর এই প্রবণতা আমাদের ব্যবসায়ীদের কৃচ্ছ্র আর আত্মশুদ্ধির বিপরীতে নিয়ে গেছে যেন। সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা শিক্ষা অনুসরণের বদলে তারা যেন আরো সুযোগসন্ধানী ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ বাস্তবতায় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সংকট এখনো কাটেনি। বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা নৈতিক জায়গাটিকে স্বচ্ছ রাখলে সংকট হয় না। কিন্তু কে শুনবে কার কথা। সারা বিশ্বের মুসলমানরা ত্যাগ কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে, সেখানে আমাদের দেশে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। করোনাকালীন অর্থনীতিতে মানুষ যখন দিশেহারা তখন পণ্য সংকট তৈরি করে মানুষকে বিপদে ফেলা হচ্ছে। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। একটু বেশি লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্যে কেমিক্যাল মিশিয়ে এবং দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। তাদের কোনোমতেই থামানো যাচ্ছে না। সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। যারা খাদ্যদ্রব্যে কেমিক্যাল মিশিয়ে সাধারণ জনগণকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদেরকে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ওই সব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট