মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

১২ নভেম্বর: প্রান্তিক মানুষের বেদনার আখ্যান

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২২, ১০:০০ এএম

শেয়ার করুন:

১২ নভেম্বর: প্রান্তিক মানুষের বেদনার আখ্যান

১২ নভেম্বর! সত্তরের সেই ভয়াল রাত। সেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া নিশুতি রাত। অর্ধ শতকেরও বেশি সময়ের আগে ঘটে যাওয়া এই রাতের ধ্বংসযজ্ঞের কথা আজও ভুলতে পারেননি উপকূলের স্বজনহারা মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনে আমার এক ফুফুকে হারিয়েছি। গেল শতাব্দীর প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’ ও জলোচ্ছ্বাসে সেদিন লণ্ডভণ্ড হয়েছিল পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সন্দ্বীপসহ উপকূলবর্তী বিশাল জনপদ। প্রাণহানি ঘটে প্রায় ১০ লাখ মানুষের। মারা যায় লাখ লাখ গবাদি পশু ও জীবজন্তু।

সেদিন শোক জানানোর মতো তাদের কারও স্বজন ছিল না। স্বজনদের হারিয়ে সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আজও যারা বেঁচে আছেন সেদিনের সেই বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়তেই তারা আঁতকে ওঠেন। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এই ধবংসযজ্ঞের বর্ণনা ছিল- ‘মানুষের মৃতদেহগুলি কচুরিপানার ঝোঁপের মতো সমুদ্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে।’


বিজ্ঞাপন


গত শতাব্দীর ত্রিশ দশক থেকে শুরু করে পঞ্চাশ দশকে নোয়াখালীর মানুষগুলো আতঙ্কগ্রস্ত জীবন-যাপন করছে। দিনের পর দিন অস্থিরভাবে তারা আশ্রয় হারানোর আশঙ্কায় অতিবাহিত করেছে। সাজানো সংসার, ঘর-বাড়িসহ ঐতিহ্য আর সভ্যতা ধারণে সুস্থির একটি শহরকে নদীর প্রচণ্ড ছোবল থেকে রক্ষার জন্য তাদের সেকি ব্যাকুলতা! নির্মম সর্বনাশা মেঘনা নদী যেন মানুষের সৃষ্টিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছে। সর্বনাশার ছিনিমিনি খেলায় দুর্বিষহ হয়ে উঠে হাজার হাজার মানুষের জীবন।

নদীর উন্মত্ত উচ্ছ্বাসে শত সহস্র সরল-সহজ জীবনের অবসান ঘটে। ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতির তাণ্ডবে হলো বিপর্যস্তÍ। আবার বিক্ষুব্ধ প্রকৃতির আঘাতে আঘাতে কঠিন রূপের মুখোমুখি হলো এখানকার মানুষ। জীবনকে জানলো তারা নতুনভাবে। পৃথিবীর এই সন্তানরা আবারও জীবনের সজীবতার স্পর্শ খুঁজে পেল।

দেশের উপকূলজুড়ে এখন নতুন ফসল কাটার মৌসুম। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের পরিবেশও ছিল একই। নবান্নের এমনি সময়ই বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। ‘সিডর’, ‘রেশমী’, ‘আইলা’র আঘাতের সংবাদ এ অঞ্চলের মানুষ আগাম জানতে পারলেও ’৭০-র ‘গোর্কি’র কথা আবহাওয়া দফতর আগে জানাতে পারেনি। প্রকৃতির কাছে আজও অসহায় উপকূলের মানুষ। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন তাদের অসহায়ত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সত্তরের ১২ নভেম্বর অন্য উপকূলের মতো নোয়াখালী উপকূলেও ২৫ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এতে জেলার হাতিয়া, সুবর্ণচর, সদর ও কোম্পানীগঞ্জ উপকূল বিরান জনপদে পরিণত হয়। নিহত হয় প্রায় ২ লাখের বেশি মানুষ। ঘটনার আগের দিন যে জনপদটি ছিল কোলাহলে মুখরিত। মাঠ জুড়ে ছিল কাঁচা-পাকা সোনালি ধানের সমারোহ।


বিজ্ঞাপন


দিনটি ছিল রোজার সময়।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে দিনভর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। সঙ্গে টানা বাতাস। সৃষ্ট নিম্নচাপটি কয়েকবার গতি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হারিকেনে রূপ নেয়। শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। রাত ১০টার পর ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত মানুষগুলো যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখনই আঘাত হানে ভয়ঙ্কর এক ঘূর্ণিঝড়। ভোর রাতে ঝড়ের তীব্রতা কমে এলে শুরু হয় স্বজনহারা মানুষের আহাজারি আর খোঁজাখুঁজি। কারও বাবা-মা, কারও স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন কেউই নেই।

গাছের ডালে, বাঁশের ডগায়, ঘরের খুঁটিতে ঝুলে আছে লাশ। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। স্বজন হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আজও যারা বেঁচে আছেন, সেদিনের বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়তেই আঁতকে ওঠেন তারা।

কথা হচ্ছিল সুবর্ণচর উপজেলার চরক্লার্ক ইউনিয়নের সত্তর বছরের প্রবীণ হাজী ফজলুল হকের সঙ্গে। সেদিনের কথা মনে করতে তিনি আবেগতাড়িত হন। তিনি বলেন, সত্তরের গোর্কিতে চোখের সামনেই ভেসে গেছে ছয় ছেলে। কিছুই করতে পারিনি। সারারাত কোনোমতে গাছ ধরে বেঁচে থাকলেও ভোর হতেই দেখি বানের পানিতে পরিবারের ৩১ জনের মধ্যে ২৪ জনই ভেসে গেছে। একটি লাশও পাইনি কবর দিতে।’

দায়িত্বের কারণে তাকে তখন গ্রামবাসীর লাশ কবর দেওয়া আর ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে নেমে পড়তে হয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষ আর গবাদি পশুর লাশ সৃষ্টি করেছিল এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। সেদিন মানুষ আর পশুর লাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। একটি লাশও কবর দিতে পারেননি তিনি।

প্রয়াত সাংবাদিক এম সানাউল্লাহ্ নূরী’র সত্তরের প্রলয়-ভয়াল গোর্কি লেখায় যেভাবে ধ্বংসের কথা ফুটে উঠে- ‘১৯৭০ সালের ঘূণিঝড় ও গোর্কি হলো কার্তিক মাসের ২৮ তারিখে অর্থাৎ ১২ই নভেম্বর। ঢাকায় একদিন আগে ঠান্ডা দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির আলামত দেখেই বুঝে ছিলাম, আমাদের রামগতি, হাতিয়া এবং উপকূল অঞ্চলে কি ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে। আমি তখন দৈনিক বাংলায় (সাবেক দৈনিক পাকিস্তান) সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলাম। তখনকার প্রাদেশিক কৃষি দফতরে উচ্চপদস্থ অফিসার আবদুর রব চৌধুরী সিএসপি এবং রামগতির (সাবেক) এমপিকে পরদিন টেলিফোন করলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে বললেন: চলুন আমরা দুজনে একসঙ্গে গিয়ে রামগতির অবস্থা দেখে আসি।

সকাল ৮টায় দিকে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে সোজাসুজি আমরা রামগতি বাজারের নিকটবর্তী চর এলাকায় পৌঁছলাম। সেখানে স্তূপীকৃত লাশ এবং মৃত গবাদি পশুর যে হাল দেখলাম তা ভাষায় অবর্ণনীয়। রামগতি বাজারের একজন সৌখিন ফটোগ্রাফার আমাকে ফুলের মতো ফুটফুটে চারটি শিশুর ছবি দিয়েছিলেন। সেটি আমি ছেপেছি দৈনিক বাংলায়। আবদুর রব চৌধুরী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করে দুর্গত অঞ্চলের জন্য রিলিফ কমিশনারের জন্য দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমি আমার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের থেকে একটানা কয়েকদিন ধরে ঢাকায় দৈনিক বাংলার জন্য রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলাম। এতে কাগজের প্রচার সংখ্যা ত্রিশ হাজার থেকে একলাখে উঠেছিল। চট্টগ্রামে সে সময় এক টাকা দামের কাগজ পাঁচ-ছ টাকা বিক্রি হচ্ছিল।

আমরা চরবাদাম, চরসিতা এবং চরজব্বরে ধানক্ষেতগুলোকে নাকে মুখে লোনা পানি লেপ্টানো হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। সাগরে ভাসতে দেখেছি অসংখ্য লাশ। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। একটি গাছের ৩০ ফুট উঁচু মাথায় অসহায় দুর্গত কুকুরকে দেখেছি হাহাকার করতে। কোথাও পানি উঠেছে ৪০ ফুট ওপরে। গোটা উপকূল অঞ্চলে প্রায় অর্ধকোটি লোক মৃত্যুবরণ করেছে। ১২৮৩ সালের গোর্কির চেয়ে বহুগুণে করুণ এবং ভয়াবহ ছিল ’৭০ সালের গোর্কি। এর ধ্বংসলীলা তো আমরা নিজের চোখেই দেখেছি। সারা দুনিয়ায় সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ হয়েছিল এই প্রলয়ঙ্কারী ভয়াল দুযোর্গের খবর।’

ভয়াবহ স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে নোয়াখালীর চরক্লার্ক ইউনিয়নের প্রবীণ আলাউদ্দিন বলেন, ‘সন্ধ্যার পর চারিদিকে শোঁ শোঁ আওয়াজে বাতাস বইতে থাকে। হঠাৎ ভয়ঙ্কর গর্জনে আকাশ অন্ধকার করে প্রচণ্ড বেগে ঝড়ো হাওয়ার শুরু হয়। ওই হাওয়া আমাকে উড়িয়ে কোথায় উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলতে পারিনি। পরদিন সূর্যোদয়ের পর আলোতে বাঁশের ঝোঁপ ধরে মাথা তুলে দেখি চারদিকে লাশের সারি। লাশ দেখে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের লোকজনের কথা কথা মনে পড়ে। তিনদিন পর একটি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে দেখি পরিবারের কেউই বেঁচে নেই।’

১২ নভেম্বরের এমন ভয়াল ট্র্যাজেডিতে পাকিস্তান সরকার কোনো সাহায্য-সহযোগিতা দেয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের পরেও কোনোভাবে বেঁচে ছিল, তাদের অনেকে মারা যায় খাবার আর পানির অভাবে। মহামারি আকারে দেখা দেয় ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ব্যর্থতা ও অবহেলা তুলে ধরে বলেন-‘এটা আমাদের জন্য লজ্জাকর। ...আমরা আজ এই সংকল্প করছি যে, উপকূলীয় এলাকায় আমাদের ভাইদের ওপর যা ঘটেছে, ভবিষ্যতে তা আর ঘটতে দেওয়া যাবে না।’ তিনি গোর্কি-উপদ্রুত মানুষের ত্রাণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। দেশের মানুষের বিদ্রোহ থামাবার জন্য ইয়াহিয়া খান সারাদেশে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।

তারিখটি নির্ধারণ করা হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। নির্বাচনের কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া জলোচ্ছ্বাসে পাকিস্তানের অমানবিক অবহেলার শিকার বাঙালিরা বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আর আমাদের থাকা দরকার নেই।

বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নোয়াখালীতে আসেন। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী, বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে নিজে কোদাল ঝুড়ি নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে সড়ক বাঁধা কাজ উদ্বোধন করেন। ‘শেখের কিল্লা’ নামে পরিচিত স্থানটি রামগতি সমবায়ের ও মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে স্থাপিত গুচ্ছগ্রাম।

সত্তরের এই দিনে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে সব হারানো মানুষ তাদের মৃত স্বজনদের হয়তো স্মরণ করবে। স্বজন ও সম্পদ হারানোর ব্যথা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে দুঃখাতুর করবে সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের করণীয় ঠিক করতে হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করলে তার ভয়াল থাবা থেকে আমাদের নিস্তারের উপায় নেই, এটা স্বীকার করতেই হবে। বিশ্বজুড়েই মানবসৃষ্ট যেসব কারণে প্রকৃতি আজ তার রুদ্ররোষ নিয়ে ক্রমাগত অন্যায় ফিরিয়ে দিতে চলেছে সেই রুষ্ট প্রকৃতিকে তুষ্ট করার দায়ভার আমাদের নিতে হবে।

আমাদের দেশের অরক্ষিত উপকূলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষার প্রাকৃতিক উপায় এর চারদিকে নিরবিচ্ছিন্ন সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা। এতে দুর্যোগকালীন জানমাল ও সম্পদহানির ক্ষতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এর সফল প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেছে।

আইলা, সিডরের প্রবল প্রতাপের বিরুদ্ধে সুন্দরবন প্রাকৃতিক রক্ষাকবচের কাজ না করলে আরও কী বিপুল ক্ষতির শিকার হতে হতো তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। আশার কথা সরকার বাংলাদেশের সমস্ত উপকূলজুড়ে সবুজ বেস্টনী গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর পাশাপাশি দরকার দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সঠিক করণীয় ঠিক করে এর দ্রুত বাস্তবায়ন করা। সাধারণ মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে করণীয় জ্ঞান প্রদান করা ও সাইক্লোন শেল্টার জাতীয় নিরাপদ স্থানের সংখ্যা এবং সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা। আমরা চাই না আর কোনো ১২ নভেম্বর তার ভয়াল থাবা নিয়ে আসুক। অনাগত সকল ১২ নভেম্বর উপকূলীয় প্রান্তিক মানুষের কাছে সজাগ থাকুক হেমন্তের সুন্দর রোদেলা সকালের সুখ-সমৃদ্ধির পরশ নিয়ে।

দিবসটি জাতীয় ঘূর্ণিঝড় দিবস হোক।

লেখক: সাংবাদিক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর