গণমাধ্যম সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমের যে প্রত্যাশিত ভূমিকা, সে কারণে গণমাধ্যমকে একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়।
একটা দেশে সংবাদমাধ্যম কতখানি স্বাধীন সেটার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে সে দেশের মানুষের তথ্য পাওয়ার অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, চিন্তা ও সর্বোপরি বিবেকের স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার। কারণ মানুষের বিবেকের স্বাধীনতার সঙ্গে তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে সমাজে মানুষ নিজের মনের কথা নিঃশঙ্কচিত্তে উচ্চারণ করতে পারে না, সে সমাজে বিবেকের দিশাও হারিয়ে যায়। সমাজের মানবিক মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞাপন
সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যম আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চর্চাগুলোর ভিতর মধ্যস্থতায় লিপ্ত আছে, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পরিচয় নিমার্ণ করছে, আমাদের জীবনযাত্রার নকশা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তাই গণমাধ্যম হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। গণমাধ্যম বা মিডিয়ার ক্ষমতা অনেক। কিন্তু সে ক্ষমতার প্রয়োগ সে নিজে করতে পারে না। অর্থাৎ গণমাধ্যমের নিজের স্বাধীন কোনো সত্তা নেই। দৃশ্যত যে গণমাধ্যম ক্ষমতা আমরা দেখি তার অন্তরালে রয়েছে পুঁজির রাজনৈতিক সামাজিক শক্তি, অর্থাৎ ক্ষমতা কাঠামোর শক্তি। যা এখন দেশীয় সীমানা থেকে বিশ্ব পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। যা এখন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাতে এবং মুনাফার স্বার্থে গণমাধ্যম কথা বলে এবং অন্যদেরকে কথা বলায়। সহজ কথায় বলতে গেলে, মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে মিষ্টিমুখ করার মতো অবস্থা।
আরও পড়ুন
আজ যখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন করে ঝগড়া বাঁধে, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে এবং নতুন করে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলের যুদ্ধ চলমান তখন সংবাদ নিমিষে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে ছড়িয়ে যায়। যেটা দেড় যুগ আগেও সম্ভব ছিল না। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, ইন্স্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ গড়ে উঠেছে কত রকমের প্ল্যাটফর্ম।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বযুদ্ধের সময় সংবাদপত্রের ভূমিকা চিরস্মরণীয়। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলা সংবাদপত্র পত্রিকার ভূমিকা ঐতিহাসিক। আসলে আমার আজ মনে হয় সংবাদমাধ্যম বৃক্ষটি আজ নানাভাবে বিস্তার লাভ করেছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে।
বিগত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে সরকারি টেলিভিশন ছাড়াও বেসরকারি মালিকানা টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেল চালু হয়। বর্তমান মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও চালু হয়েছে অনেক স্যাটেলাইট চ্যানেল। যার মালিকানায় রয়েছে মন্ত্রী, এমপি অথবা ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা। প্রচারেই প্রসার এবং মুনাফা-কেন্দ্রিক চিন্তাধারায় আমাদের বড় রাজনৈতিক দুটি দল বেসরকারি টিভি চ্যানেল চালুর করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। বিটিভির খবর ও অনুষ্ঠানের একপেশে রাজনীতি নিয়ে অহরহ চলছে সমালোচনা। অন্যদিকে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ ও অনুষ্ঠান— এর চেয়ে ভালো কিছু হচ্ছে কি? সরকারি কিংবা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটি, প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মহাসচিবের ব্রিফিং, সভা সেমিনার এবং নিজ রাজনৈতিক ব্যানারকে সংবাদে গুরুত্ব দেওয়া।
দলীয়করণের বেলায় গণমাধ্যমকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে রাজনীতিবিদরা। অথচ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের কাজ সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভুলত্রুটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া। মনীষীরা বলে থাকেন, সমাজ জীবনের ঢেউ, চমক, স্পন্দন আর অনিয়ম নিয়েই গণমাধ্যমের অস্তিত্ব। মানুষ প্রত্যাশা করে সরকারি, বেসরকারি, বহুজাতিক বা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যাদের কাজের সাথে জনগণের স্বার্থ জড়িত, গণমাধ্যম তাদের কাজের ওপর নজরদারি রাখবে, জনবিরোধী বা কোনো অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি হলে সেসবের সমালোচনা করবে। গণমাধ্যমকে তাই ‘আই অন গভর্নমেন্ট’ বলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া মালিকরাই যদি হন রাজনৈতিক দলের নেতা, দলের লোক এবং ব্যবসায়ী। মুনাফা আর দলীয় সমাচারই যাদের প্রধান উদ্দেশ্য তখন মিডিয়া কিভাবে ‘আই অন গভর্নমেন্টে’র গুরুদায়িত্ব পালন করবে?
জনসাধারণের মনে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নাগরিকবোধ, জনমনে ক্রমশ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে সার্বভৌমত্বের ধারণা। আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের পাশে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যম, যা কার্যত রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে। গণতান্ত্রিক অনুশীলনের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা।
মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার ইউরোপে নবজাগরণের সূচনা ঘটিয়েছে। উনিশ শতকে বিজ্ঞানের এ অর্জন সংবাদপত্রের ইতিবৃত্তে আধুনিকতার উদ্বোধন ঘটায়। চীনে হাতে লেখা খবরের কাগজের চল থাকলেও ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি ভারতবর্ষেও সংবাদপত্রের আÍপ্রকাশ ঘটে এ শতকেই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সংবাদপত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রাধান্য সুস্পষ্ট ছিল। তবে এ কথাও সত্য যে, সরকার বা সরকারবিরোধী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা বা জনমত সংগঠনে সংবাদপত্রের প্রবল ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে যুগ নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তান শাসনামলে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, জনপদ, দৈনিক আজাদ, অবজারভার যেভাবে বাঙালির অন্তর্গত চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছিল, গণমাধ্যমের মহত্ত্ব, সক্ষমতা ও জনসম্পৃক্ততা যেভাবে একটি জাতিসত্তার বিকাশে ইতিহাস-নির্ধারণী ভূমিকা রেখেছিল, তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জয় বাংলা, বাংলার বাণী, সংগ্রামী বাংলা, মুক্তবাংলা, জাগ্রত বাংলার মতো অনেক পত্রিকা কখনো মুক্তাঞ্চলে, কখনো প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনতাকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল; উত্তাল মুক্তিকামী জনতাকে জাতীয়তাবাদী জনউচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত করেছিল— তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সংবাদপত্র নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। মানুষের ভাবনা, চিন্তা, ধর্ম, রাজনীতি, আদর্শের বাহনে পরিণত হয় এ গণমাধ্যম।
মাতৃভূমির মুক্তির জন্য শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজউদ্দিন হোসেন বা গোলাম মুস্তফার মতো মহৎপ্রাণ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের মহান আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। আর এ জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথে শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে আÍবলীদানের এ বিরল দৃষ্টান্ত একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধের প্রকৃতি, ব্যাপ্তি ও চরিত্র সম্পর্কে অনাগত সময়ে সমাজ গবেষকদের কৌতুহলী উপাদান জুগিয়ে চলবে— এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
১৯৭৫-এ মানবসভ্যতার কলঙ্কজনক স্খলন, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করা বা প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের উত্থানকে নিরুৎসাহিত করায় গণমাধ্যমের ভূমিকাকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় মনে হয়েছে। অথচ বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী সামাজিক মনস্তত্ত্ব নির্মাণে গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ অবদান থাকবে এটিই কাম্য, প্রত্যাশিত ও কাক্সিক্ষত।
আরও পড়ুন
বিগত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অকল্পনীয় উন্নতির ফলে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ও রেডিওর মতো গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমের পাশে জায়গা দখল করে নেয় ব্যবস্থা পরিচালনা বিজ্ঞান বা সাইবারনেটিক্স। গড়ে ওঠে বিশাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, ই-মেইলের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সংযুক্ত হওয়া যায় এক নিমিষেই।
দেশের রাজনীতির সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে পারা যায় না। এই সংকট রাজনীতিকদের নিজের দায় এড়ানোর সংকট। যে কোনো কৌশলে ক্ষমতায় আরোহণ এবং অধিষ্ঠিত থাকার নীতি মেনে চলার সংস্কৃতিকে ধারণ করার সংকট— যার ফলে তাদের কাছে সাধারণ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করা এবং সুরক্ষা দেওয়ার দায় নিয়ে রাজনীতি অগ্রাধিকার পায় না। সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব পালনে তারা যখন ব্যর্থ হন, স্বভাবতই ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হয় না। এর সুদূরপ্রসারী ক্ষত ও ক্ষতি হলে সমাজ থেকে পরিচয় নির্বিশেষে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের নীতি অনুসরণ করা যে দৈনন্দিন জীবনাচরণের অপরিহার্য চর্চার বিষয় তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা থেকে মানুষ ক্রমাগত দূরে চলে যাচ্ছে। আজকে বাংলাদেশের বাস্তবতা যেন এটাই। তবে এই সংকটের দায় সবার। নয়তো দায়িত্ব এড়িয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা দিনের পর দিন পার পেয়ে যান কী করে? তারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্যতা বোধ করেন না কেন?
এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন নিজের দিকে স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে তাকানো। ব্যক্তিজীবনে, সামাজিকতায়, নাগরিক ভাবনায়, মননে, রাষ্ট্রের সঙ্গে অধিকার ও দায়িত্বের বোঝাপড়ায় আমরা কোন নীতি অনুসরণ করছি? মুখে যা বলছি বিশ্বাস নিয়ে বলছি কি? যা বলছি তা বাস্তবায়নে নিজের ভূমিকাটি সৎভাবে পালন করছি কি? এ প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে ভয় না পেয়ে দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলে আমরা নিজে এবং দেশ ও সমাজ এই সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজে পাবো। সৎ ও সাহসী গণমাধ্যম এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
/জেএম

