বুয়েটে পড়ুয়া প্রকৌশলীরা দেশের কূটনৈতিক দায়িত্ব নিলেও কাজটি এখন সরাসরি দেশ-বিদেশে করে দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে বিশ্বমহলে। সঙ্গে আমার ভাবনায় ঢুকেছে, তাহলে পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই যে সব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সহজ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে তার চর্চা যদি না হয় তখন সে বিদ্যা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আসুন তাহলে চর্চা নিয়ে তুলে ধরি সেকালের একজন মুক্তিযুদ্ধের বার্তাবাহকের জীবন কাহিনী।
আমি তখন খুবই ছোট। তারপরও কেন যেন মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দেখার স্মৃতি, মনে পড়ে যায় সেই হৃদয় দেবার তিথি। হালকা-পাতলা শ্যামলা বর্ণের এক তরুণী মহিলা বাঙালির আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ফরিদপুর ছেড়ে এসেছিলেন আমাদের গ্রামে স্বামীর হাত ধরে, সাথে ফুটফুটে ছোট্ট একটি কন্যা শিশু নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
সম্পর্কে তিনি আমার দাদি হলেন। দাদি তো সবাই বয়স হলে হয়, কিন্তু এ তরুণী দূর-সম্পর্কের দাদার বউ হবার কারণে হলেন আমারও দাদি। শুরুতেই বলেছি, বয়স আমার বেশি না তবে দাদির সঙ্গে রং-তামাশা করা যায় এতটুকু বয়স হয়ে গেছে। তা একবার দাদিকে বলেছিলাম, ও দাদি তুমি কি বাঙালি?
আরও পড়ুন
দাদি কড়া উত্তরে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি বাঙালি আর তোরা হলি সব পাঞ্জাবি।’ যাই হোক, প্রতিবেশী দাদা তেমন সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন না, দিনমজুরের কাজ করতেন। দাদি তার মেয়েকে নিয়ে আমার মাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। দাদির মেয়ের নাম ছিল হাসি, সেক্ষেত্রে হাসির মা বলেই অনেকে তাকে ডাকতেন।
বিজ্ঞাপন
মূলত আমাদের ‘দাদি’ বলে সম্বোধন করা তিনি পছন্দ করতেন না। করবেনই বা কী করে? অল্প বয়সের একজন মহিলাকে দাদি বললে নিশ্চয়ই মন খারাপ হবারই কথা তখন। আর আমি তো তখন ছোট, অত কিছু বুঝি নাকি?
তবে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা যে বুঝতেন, সেটা গতকাল টের পেলাম যখন ভাইকে দাদির ব্যাপারে কিছু স্মৃতিচারণ করতে বলেছিলাম। বড় ভাই সবসময় হাসির মা, পরে দাদি শব্দটি যোগ করলেন। যাই হোক, হাসির মা দাদি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে বড় ভাই দাদিকে ফ্লাইং বার্ড বলেছেন, বলেছেন ফ্রি ল্যান্সার, বলেছেন অলস, বলেছেন প্রতিবাদী, বলেছেন বার্তা বাহক। কারণ এর সবগুলোই নাকি মূলত বাঙালির বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়ার মানুষের পুরনো ইতিহাস ঘাটলে সত্যিকারার্থে তখনকার মনীষীদের জীবনী এমনটিই ছিল।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুচিত্রা সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শেখ মুজিবসহ হাজারও উদাহরণ রয়েছে যারা কোনো এক সময় চাপে এবং তাপে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে নানাভাবে বিপ্লবমুখর হয়েছিলেন। এরা সবাই কিন্তু নিজ নিজ জায়গা থেকে মেধার গুণেই আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে আলো দান করেছেন। যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি চিত্রজগত, পেয়েছি বাঙালির বাঙালিত্ব, পেয়েছি বাংলা দেশ, পেয়েছি বিশ্ব কবি, পেয়েছি জাতির পিতা।
আমার মেমোরিতে যতটুকু তথ্য রয়েছে তাতে মনে হয় হাসির মা দাদি দারিদ্র্য মোচনে নয়, বরং ভালোবাসার টানে ফরিদপুর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নবগঙ্গা নদীর তীরে নহাটা গ্রামে। গ্রামটি বর্তমান মাগুরা জেলাধীন। দাদি বাঙালির বাঙালিত্বকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের এলাকায় এবং বিদ্রোহের বার্তাবাহক হিসেবে হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়েছিলেন সেদিনের সেই প্রথম দেখায় যখন আমার কথার উত্তরে বলেছিলেন, ‘তোরা পাঞ্জাবি।’
এই মুহূর্তে স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে দেখছি, যতটুকু আলো আসছে মনে, সে আলোয় দাদির সে রাগান্বিত বার্তা দেখতে পারছি। ভাবছি, তাই বুঝি সেই অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিলাম শুধু আজীবনের মতো পাঞ্জাবি শব্দটাকে মুছে ফেলতে। যেই কথা সেই কাজ, সরিয়েছিলাম সেই শাসক গোষ্ঠীকে, মুক্ত করেছিলাম বাঙালির বাঙালিত্বকে। দাদিকে দেখেছি কী প্রচণ্ড দক্ষতার সঙ্গে খবর বহন করেছেন তৎকালীন মুক্তি বাহিনীর মাঝে। দাদি রাজাকারদের ঘাঁটিতে গিয়েছেন, তথ্য জোগাড় করেছেন, এলাকার কোথায় কি ঘটেছে সেটা সবার আগে প্রচার করেছেন। মনে হতো দাদির কাছে গেলেই সবার আগে সর্বশেষ খবর মিলবে এবং সেটাই হতো সবসময়। দাদির কোনো পুঁথিগত বিদ্যা ছিল না। তবে বিচক্ষণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন তার বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে। দাদির কূটনীতি সবসময় তথ্যবহুল এবং ক্রিয়েটিভ বার্তা বহন করেছে তখন।
দাদি আজও বেঁচে আছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। কঠিন সময়ের মাঝে বেঁচে থাকার কারণ হতে পারে আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের বংশ পরিচয়— অতীতে কী ছিলাম আর বর্তমানে কী হয়েছি।
আমাদের দাদি অতি সাধারণ একজন মানুষ। তার জীবনের ছোটখাটো ঘটনা সম্পর্কে আমি মোটামুটি সচেতন, তবে আমার বাবা-মা মারা যাবার পর কিছুটা হালকা হয়েছে সম্পর্ক। আমার লাস্ট ভ্রমণ সম্ভবত ২০১৪ সালে, দুইদিন নহাটাতে ছিলাম। কিন্তু বলতে গেলে পুরো সময়টুকু তার সঙ্গে কেটেছিল আমার। সুখ-দুঃখের অনেক কথা শেয়ার করেছিলেন তখন। কেন যেন মনে আসেনি তখন দাদিকে প্রশ্ন করে জানতে যে দেশ স্বাধীন হলো, কেউ পেলো, কেউ শুধু হারাল কিন্তু দাদি কেন সব চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো? ৭১ এর যুদ্ধে হারালেন দাদি তার বাড়ি, ১২-১৩ বছরের মেয়ে হাসিকে এবং পরে তার স্বামীকে পাঞ্জাবিদের নির্মম অত্যাচারের কারণে। দাদির হারানোর গল্পের শেষ হয়নি বা সমাজ তথা দেশ থেকে তেমন কিছু পাননি, কিন্তু কেন? সে আলোচনাও হয়নি। আমার বাবা-মা হারানোর ব্যথা আমার মনে তখন যেভাবে হাহাকার করে ব্যস্ত রেখেছিল আমাকে, দাদি সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। তাই হয়তো তার দুঃখের কথা শেয়ার করে আমার দুঃখের বোঝা বাড়াতে চেষ্টা করেননি সেদিন!
হঠাৎ দাদির ছোট্ট একটি ভিডিও দেখে মনে হলো তার দারিদ্র্য চরমে। কোনোক্রমে দু-এক বেলা খেয়ে না-খেয়ে থাকেন। নহাটা বাজারে গিয়ে তার চিকিৎসা করানোর কোনো সাধ্য নেই। তাকে চিকিৎসা করাতে না পারলেও তাকে অবহেলা করা আমাদের ঠিক হবে না।
আরও পড়ুন
আমি মনে-প্রাণে আশা করি রাষ্ট্র থেকে শুরু করে আমরা সবাই যেন আমাদের এই বেঁচে থাকা বাঙালি দাদির জন্য কিছু করি একসঙ্গে। আমরা যদি বাংলাদেশে আবারও একটি পয়লা বৈশাখ পাই, যেন বৈশাখের মেলায় অনেক মানুষের ভিড়ে দাদিকেও দেখতে পাই। দাদির মুখে যেন শুনতে পাই— মেলায় গিয়েছিলাম, শুনলাম এবং দেখলাম একটা ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে, কী দারুণ! বাঁশি যে আসলেই ডাকাতিয়া হয়, এর আগে বিশ্বাস করিনি। এই শীতেই যেন আমরা দাদিকে নতুন করে একটি বিশেষ উপহার দিতে পারি। দাদির জন্য আমরা সবাই ছোট্ট একটি ভালোবাসার সুখের ঘর তৈরি করে দিয়েছি। দাদির মুখে যেন এবারের বৈশাখে নতুন কিছু হাসির কথা শুনতে পাই। শুনতে পাই যেমন দেশের মানুষ গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে, নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছে।
শেষে বলতে চাই, হে বাংলাদেশ! তুমি পঞ্চাশ বছরে যা করতে পারনি তোমার ডিপ্লোমেসি দিয়ে সেটা করেছেন বর্তমান বঙ্গবন্ধু কন্যা গত কয়েক মাস ধরে। গোটা বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি তার নিজস্ব কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। আশা করি, দেশের এবং গোটা বিশ্বের কূটনীতিকরা তার এই কূটনৈতিক পারদর্শিতা থেকে কিছু শিখবে এবং তোমাকে বিশ্ব দরবারে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
হে প্রিয় জন্মভূমি, তোমাকে আজও প্রতিক্ষণে মনে পড়ে। আজ আমার জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, তবু মনে হয় কী যেন নেই! আমার এই হৃদয়জুড়ে আজ অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে আছে, তোমাকে কাছে না পাওয়ার শূন্যতা। তোমার দেওয়া স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে আজও বেঁচে আছি। বিধাতার কাছে আমার একটাই চাওয়া, জীবনের শেষবেলায় হলেও যেন দেখতে পাই তুমি সত্যিকার সোনার বাংলা হয়েছো, যেখানে হাসির মা দাদির মতো কেউ যেন আর পরের দুয়ারে হাত না পাতে শুধু একটু অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের জন্য!
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
/জেএম

