শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নাক-মুখ চেপে চলতে হয় নগরবাসীকে

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৩৯ এএম

শেয়ার করুন:

নাক-মুখ চেপে চলতে হয় নগরবাসীকে

আরিফুর রহমান একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাস্টার্সে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়তই মাস্ক ব্যবহার করতে হয় ধুলার কারণে। অতিরিক্ত ময়লা বা ধুলোর দূষণ তার শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দেয়। ফলে করোনা আসার আগে থেকেই নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করেন তিনি। বাহিরে বের হওয়ার সময় একদিন না পরলেই নানা সমস্যায় পড়েন তিনি।

আরিফুর রহমানের মতো স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেই না থাকলেও অনেক মানুষের এইরকম সমস্যা রয়েছে। যারা অতিরিক্ত দূষণ বা অল্প দূষণে নাকমুখ বন্ধ হয়ে আসে। প্রতিনিয়ত নাকমুখ চেপে পথ চলতে হয় এই শহরে। সম্প্রতি ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগতভাবে চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত সপ্তাহে প্রতিদিনই দূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা। বায়ু দূষণ কমাতে নগর এলাকাসহ সারাদেশে অবকাঠামো, ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যথাযথ মানদণ্ডে প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।


বিজ্ঞাপন


গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে এমনকি অলি-গলিতেও দেখা গেছে দূষণ থেকে রক্ষা পেতে মানুষ চলাচল করছে নানা উপায়ে নাকমুখ চেপে। তেজগাঁও কলেজের পাশে আড্ডা দেওয়া কতিপয় শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মাস্ক পড়া। তাদের একজন ইমজিয়াজ সোহেল বলেন, করোনার কঠিন সময়ে বাসায় ছিলাম সবাই। করোনা একটু কমলেও এতো মাস্ক পরিনি এখন এই দূষণের কারণে যে পরিমাণ পরতে হয়। পাশে ভাসমান ফল বিক্রেতা জসিম উদ্দিন বলেন, শীতে ধুলা বেড়ে যায়। আমরা হকার রাস্তায় এটা ওইটা কেটে বিক্রি করি। একদম খোলা রাখলে ধুলোর আস্তর পরে যাবে তখন কাস্টমার খাবে না। আবার বেশি করে বন্ধ রাখলে কাষ্টমারের চোখে পড়ে না। তাই উপরে পাতলা পাষ্টিকের পলি দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়।

>> আরও পড়ুন: সনাতন পদ্ধতিতে বর্জ্য অপসারণে বাড়ছে বায়ু দূষণ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামালউদ্দিন জানান, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে।

বায়ু দূষণকে এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগের চেয়ে ও ভয়ংকর মন্তব্য করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বায়ু দূষণ কমানো সম্ভব হবে না।


বিজ্ঞাপন


dm

গত কয়েকদিন সরেজমিনে বসুন্ধরা, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর এলাকায় পথচারীদের নাক মুখ চেপে চলাচল করতে দেখা যায়। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদেরও দেখা যায় এই দূষণ থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক পরে থাকতে। কারওয়ান বাজারে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সদস্য ঢাকা মেইলকে বলেন, আট ঘণ্টার ডিউটটিতে যে গাড়ি যাতায়াত করে এই ধুলায় কয়েকদিনে বড় বড় অসুখ হয়ে যাবে। মাস্ক পরে থাকি। ডিউটির সময়ে দেড়-দু ঘণ্টা পর মাস্ক পাল্টাতেও হয়। অনেক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য ধুলায় অসুস্থও হয়ে পড়েন বলেও জানান তিনি।

বিজয় সরণিতে দায়িত্বরত এক সার্জেন্ট বলেন, আমাদের কাজই রাস্তায়। বর্ষায় বৃষ্টি, শীতের ধুলা সব কিছুতেই অভ্যস্ত আমরা। মানুষকে সেবা দিচ্ছি। নিয়ন্ত্রণহীন ধুলার সাথে বিভিন্ন যানবাহনের ধোঁয়া আছে, বিভিন্ন প্রকল্প নির্মাণ হলে বিভিন্ন দূষণ হয় তবে আমরা চেষ্টা করি নিজেরাই সুরক্ষিত থাকতে কারণ নিজেকে সুস্থ রাখলেই সেবা দিতে পারবে।

>> আরও পড়ুন: স্কুলপাড়ায় ধুলার রাজত্ব

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বায়ু দূষণ রোধে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক শহরের ৩০ ভাগ বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা ও আশেপাশের শহরে এমন সবুজায়ন ও বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দূষণ রোধে সফল কলোম্বিয়ার বোগোটা, পোল্যান্ডের ওয়ারশ, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, ঘানার আক্রা প্রভৃতি শহরের মতো ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে পাবলিক বাসের সংখ্যা বাড়ানো ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং সবুজ বাহন তথা সাইকেল ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।

dm

রাজধানীর অনেক এলাকায় দিনের বেলায় ধুলার কারণে প্রায় অন্ধকার হয়ে যায়। বিশেষ করে ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে যেন ধুলার স্বর্গ রাজ্য। বসিলা হয়ে মোহাম্মদপুর, গাবতলি এলাকায় একের পর এক গাড়ির যাতায়াত সড়কে ধুলাকেও যেন বিশ্রাম নিতে দেয় না! ওই এলাকায় সাধারণ পথচারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ীদেরও ব্যবসা করা যেন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দোকানের সাটারগুলোতে ভেতরের ফার্নিচারগুলো ধুলার আস্তর দেখা গেছে।

গাবতলি এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দোকানের বেঞ্চ পরিষ্কার করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ধুলার আস্ত পড়ে যায়। বার বার মানুষ বসে তাই আর পরিস্কার করা লাগে না। তবে আমাদের অন্য আসবাবপত্র যেখানে ক্রেতাদের ছোঁয়া লাগে না সেখানে তাকালেই বুঝা যায় কেমন ধুলা উড়ছে।

>> আরও পড়ুন: ধুলার রাজ্যে অসহায় রাজধানীবাসী

এদিকে, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) জানিয়েছেন, নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ইটভাটার ধোঁয়া, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়ি, অবকাঠামো ও মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো প্রভৃতি কারণে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছ। শুষ্ক মৌসুমে যার প্রভাব থাকে সবচেয়ে বেশি। 

আইপিডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার চেয়েও নারায়ণগঞ্জ এলাকার বায়ুমান বিপজ্জনক মাত্রাকে আরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে, পুরো জানুয়ারি মাসেই যা গড়ে প্রতিদিন বায়ুমান সূচক (একিউআই) ৪০০ বা তার চেয়ে বেশি ছিল। ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার বায়ু দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার্যকর ক্লিন এয়ার আইন করতে আমরা কেন ব্যর্থ হলাম, কারা এই আইন করতে দেয়নি - এই বিষয়গুলোর জবাব নীতিনির্ধারকদের দিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধ করতে কার্যকর প্রকল্প, নির্মাণ ও নগর ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। দূষণের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নয়টি প্রস্তাবও দিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।

ডব্লিউএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর