শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

গ্যাস সংকটে ‘টালমাটাল’ শিল্প খাত

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৭ নভেম্বর ২০২২, ০৭:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

গ্যাস সংকটে ‘টালমাটাল’ শিল্প খাত

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে পড়েছে। এরমধ্যে গ্যাস বা জ্বালানি সংকট অন্যতম। চলমান এই গ্যাস সংকটের কারণে দেশের শিল্প খাত এখন টালমাটাল। কমেছে শিল্পের উৎপাদন। উৎপাদন কমার কারণে কমেছে পণ্য রফতানি ও রফতানি আয়ও। এতে বহির্বিশ্বে বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। রফতানি আয় কমার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে দেশের রিজার্ভের ওপর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস না থাকায় দৈনিক প্রায় ১২ ঘণ্টা শিল্প-কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকছে। সব মিলে বিভিন্ন সেক্টরের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। এই অবস্থা থেকে শিগগিরই উত্তরণ না হলে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে দেশের শিল্প খাত।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস না থাকায় যে ফ্যাক্টরিতে দুই শিফট আছে সেখানে এক শিফটে কাজ করাতে হচ্ছে। অর্ধেক কাজ করিয়েও শ্রমিকদের পুরো বেতন দিতে হচ্ছে। আবার উৎপাদন কম হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। ডাইং ও ওয়াশিং প্লান্টগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু থাকলেও লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নিট কারখানাগুলোতে একবার গ্যাস চলে গেলে পরবর্তীতে বয়লার হিট করতে তিন-চার ঘণ্টা লাগে। শুধু পোশাক শিল্পেই নয়, অন্যান্য কারখানাগুলোরও বেহাল অবস্থা। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সিরামিক শিল্প।


বিজ্ঞাপন


Gasবাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও এক্সিলেন্ট সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল হাকিম সুমন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের সিরামিক কারখানাগুলোর প্রধান উপকরণ গ্যাস। আমাদের কিছু মেশিন আছে যেগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। তা না হলে নষ্ট হয়ে যায়। চলমান এই গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের উৎপাদন কমে গেছে অর্ধেকেরও বেশি। বারবার সরকারের সাথে আলোচনা করা হলেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। এই ক্রাইসিস থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএম) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ঢাকা মেইলকে বলেন, চলমান জ্বালানি সংকটের কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অপারেট খরচ বাড়ছে। উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। আবার গ্রাহকদের ঠিক মতো প্রোডাক্ট সরবরাহ না করতে পারায় তারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন।

Gasবাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএম) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, উৎপাদন একেবারে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। গাজীপুরে সকালে বিদ্যুৎ গেলে বিকাল ৫টায় আসছে। তাহলে শিল্প এলাকা থাকল কী করে? জরুরিভিত্তিতে ৫০০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস কেনার চুক্তি করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখেন। আর স্বল্পমেয়াদে দ্রুত ২০০ এমএমসিএফ গ্যাস স্পট মার্কেট থেকে কিনতে বলেন। এ পরিমাণ জ্বালানির নিশ্চয়তা পেলে আগামী এক বছর শিল্পে সমস্যা থাকবে না। এতে যদি প্রতি ইউনিটে ৪-৫টাকা বেশি দরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস কিনতে হয়, তাতেও ব্যবসায়ীরা রাজি বলে জানান তিনি।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সভাপতি স্বপ্না ভৌমিক বলেন, গত দুই মাসে ২৭টি কারখানা পরিদর্শন করেছি। তারা ভয়ে আছেন কখন বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশবান্ধব অনেক মেশিনারিজ ব্যবহার করা যাচ্ছে না গ্যাস সংকটে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে।


বিজ্ঞাপন


চলমান গ্যাস সংকট নিয়ে গত ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর সাথে আলোচনায় বসেন ব্যবসায়ী নেতারা। সেখানেও ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, দিনের ১২ ঘণ্টাই শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে উৎপাদন অনেক কমে যাচ্ছে।

কিন্তু সেদিন তেমন কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি জ্বালানি উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কি হবে। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এলএনজি আমদানি করার টাকা নেই। এখন ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ৬ মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না- জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের ভোলায় কিছু গ্যাস আছে, সেগুলো সিএনজিতে করে নিয়ে আসব। সেখানে ৮০ এমএমসি গ্যাস আছে। আমরা দু-তিন মাসে সেটা নিয়ে আসার চেষ্টা করব। অপরদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ পাব। আরও এক হাজার মেগাওয়াট সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদন করব। তখন অনেকটাই সমস্যার সমাধান করতে পারব।

Gasবিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা যখন এমন কথা বলছিলেন, তার মাঝেই এক ব্যবসায়ী দাঁড়িয়ে সমস্যা সমাধানের কথা বলতে আহ্বান জানান। তাকে সমর্থন দেন উপস্থিত ব্যবসায়ীরাও। কিছুটা হট্টগোলও হয় সেখানে। তবে অনেকটা হতাশা নিয়ে ফিরেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে অক্টোবরে পোশাক রফতানি ২০ শতাংশ কমার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত পোশাক শিল্পে টানা প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যে কারণে গত অর্থবছরে এ শিল্প খাত থেকে রফতানি হয়েছে ৪২ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু গত দুই মাসে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ক্রয়াদেশ ক্রমশ কমছে। আমার আশঙ্কা পোশাক রফতানির এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নভেম্বরেও অব্যাহত থাকবে।

টিএই/জেএম/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর