শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

জ্বালানি সংকটের সমাধান কোন পথে?

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০২২, ১০:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

জ্বালানি সংকটের সমাধান কোন পথে?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সংকটে পড়েছে দেশের জ্বালানি খাত। খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এতে সারাদেশেই দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ সংকট। সরকার এলাকাভেদে ২-১ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বললেও কোথাও কোথাও দিন ও রাত মিলিয়ে ৮-১০ ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। তীব্র গরমে দিন ও রাতে কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় জনজীবন বিপন্ন।

জ্বালানির এই সংকটকে সরকারের পক্ষ থেকে সাময়িক বলা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগতে পারে। তাই সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

জ্বালানির সংকট মোকাবেলায় গত ১৮ জুলাই (সোমবার) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় করতে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ১৯ জুলাই থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, দিনে এক-দুই ঘণ্টা লোডশেডিং, ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ, সপ্তাহে এক দিন বন্ধ থাকবে পেট্রোল পাম্প, রাত আটটার পর শপিং মল বন্ধ, সরকারি-বেসরকারি সভা হবে ভার্চুয়ালি এবং অফিসের সময় এক থেকে দুই ঘণ্টা কমানো।

আরও পড়ুন: কূটনৈতিক এলাকা ছাড়া সবখানে লোডশেডিং হবে

ওইদিন বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী জানান, করোনার অভিঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে সবাইকে সতর্ক করেছেন। এজন্য মঙ্গলবার থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত সাময়িক। বিশ্ব পরিস্থিতির উত্তরণ হলে আগের অবস্থানে ফিরে আসা হবে।

সংকটের কারণ ও উত্তরণ নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা


বিজ্ঞাপন


সরকারের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, উৎপাদন হচ্ছে তার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ কম, যা লোড ব্যবস্থাপনার (লোডশেডিং) মাধ্যমে সমন্বয় করতে হচ্ছে। সরকার গ্যাস অনুসন্ধান না করে এলএনজি আমদানিনির্ভতার কারণে এমন সংকটের মুখে পড়েছে বলে অভিমত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

এবিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশের চলমান জ্বালানি সংকটের আপাতত সহজ কোনো সমাধান নেই। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ চলছে। সেসব উদ্যোগের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগও নিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। যেসব জায়গার ওপর নির্ভর করে আছি সেটার কারণেই তো আসলে সমস্যা। সুতরাং নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ হতে এখনও বেশ সময় লাগবে। এই প্রকল্পের সাথে ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন এগুলো এখনও সেভাবে প্রস্তুত না। সুতরাং রূপপুরের ওপর নির্ভর না করে আমাদের দ্রুততম সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রিক যে সমস্ত জ্বালানি সে দিকে নজর দেওয়া উচিত।’

চলমান এই জ্বালানি সংকটকে ‘সরকারের মহাপরিকল্পনার ফল’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, সরকার গ্যাস অনুসন্ধান না করে এলএনজি আমদানি করছে। পারমাণবিকের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘চলমান যে জ্বালানি সংকট এটা তো সরকারের মহাপরিকল্পনার ফল। সরকার মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল যে, আমদানি করবে। আমদানিভিত্তিক তারপর কয়লা পরমাণুভিত্তিক, অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রকল্প সরকারের মহাপরিকল্পনায় ছিল। সরকার গ্যাস অনুসন্ধান না করে এলএনজি আমদানি করছে। কয়লা পারমাণবিকের ওপরে গুরুত্ব দিয়েছে। নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান না করার ফলে এলএনজি আমদানি যে করতে হয়েছে, এটার তো দাম অনেক বেড়ে গেছে। তেলের দামও বেড়ে গেছে। সেগুলো সমস্যা হচ্ছে।’

আরও পড়ুন: লোডশেডিংয়ে সরকারের ‘পতন দেখছে’ বিএনপি

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কোনো সমস্যাই থাকত না যদি গ্যাস অনুসন্ধান করত ঠিকমতো। আর আমরা তো প্রায় ২০ বছর ধরে বলছি যে, জাতীয় সংস্থাকে শক্তিশালী করা হোক। জাতীয় সংস্থাকে শক্তিশালী করে নিজেদের সক্ষমতার ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান করা হোক। নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা বা উৎপাদন বাড়ানো হোক। গ্যাস এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি এই দুয়ের মিশ্রণে আমাদের কোনো সমস্যাই থাকত না। স্বনির্ভর, কম ব্যয়বহুল এবং নিরাপদ বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তোলা যেত। বিদ্যুতের দামও কমে আসত। এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর দিচ্ছে, গত কয়েক বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি কিছু লোককে শুধু শুধু দেওয়া হয়েছে। এগুলোও দিতে হতো না। এ ধরনের সংকটেও পড়তে হতো না। জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়িয়ে তা ব্যবহার করা আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমে বাড়ানো এ দুটো করেই সুলভে নিরাপদ বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব।’

pp

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা সাশ্রয়ী মূল্যে উত্তোলন ও ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানিকৃত কয়লা, এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কৌশলে বিদ্যুৎ খাতের এমন সব উন্নয়ন হয়েছে, যা ভোক্তা বা গণবান্ধব নয়, অসাধু ব্যবসাবান্ধব। সরকারকে সবকিছু ব্যবসায়িক বিবেচনায় দেখলে হবে না। এসব প্রতিষ্ঠান যারা পরিচালনা করেন, তারা সরকারি কর্মচারী। তাহলে তারা লভ্যাংশ কেন পাবেন? এসব প্রতিষ্ঠানে খরচ ও আয় দুটিই বেশি দেখানো হয়। বেশি আয় দেখানো হলে কর ও ভ্যাটের পরিমাণও বেড়ে যায়। আর লভ্যাংশ, প্রফিট বোনাস ইত্যাদি নামে কর্মকর্তারা মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন।’

শামসুল আলম বলেন, ‘চলমান জ্বালানি সংকট নিয়ে বহু লোক বহুভাবে সমাধান দিচ্ছেন। আমি মনে করি, সমাধানের জন্য সরকার বিইআরসিকে বলুক, অনেকে যা পরামর্শ দিচ্ছে তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলে সেই সিদ্ধান্ত ভোক্তারাই বাস্তবায়ন করবে।’

সংকট বেশি দিন থাকবে না, বলছেন প্রতিমন্ত্রী

এদিকে, দেশে চলমান ‘লোডশেডিং’ পরিস্থিতি খুব বেশি দিন থাকবে না বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি খুব বেশি দিন থাকবে না আশা করি। এ বছরের মধ্যেই পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারত থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট আমদানিকৃত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর প্রভাব সব জায়গাতে পড়েছে। মহামারির ধাক্কা যখন সবাই কাটিয়ে উঠছিল তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বকেই গভীর এক সংকটে ফেলেছে। এই সংকট শুধু উন্নয়নশীল দেশেই না, অনেক উন্নত দেশেও এর আঁচ লেগেছে। যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি মার্কেট চরম অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক খাদ্যপণ্যের বাজারও বেসামাল। বৈশ্বিক এই সংকট আমাদেরকেও বিপদে ফেলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন: সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকবে লোডশেডিং

নসরুল হামিদ জানান, আমাদের বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বাকি বৃহৎ অংশ এলএনজি আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ও গ্যাসের উৎপাদন ছিল মাত্র দৈনিক  ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখান থেকে আমরা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছিলাম দৈনিক ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত। ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমরা এ সক্ষমতায় গ্যাস উৎপাদন করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করেছে আমাদের খনিগুলোর রির্জাভ কমে যাওয়ার কারণে।

‘এলএনজি আমদানির জন্য কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় আমরা এলএনজি পাচ্ছি। এর পাশাপাশি আমরা আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি আমদানি করতাম। কোভিড-১৯ এর আগে আমরা এক ইউনিট এলএনজি চার ডলারেও আমদানি করেছি কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা ৪১ ডলারও ছাড়িয়ে গেছে। এত উচ্চমূল্যে আমদানি করলে আমাদের অর্থনীতির ওপর বিশাল চাপ তৈরি হবে। শুধু গ্যাসের দামই না। বেড়েছে সবধরনের জ্বালানি তেলের দাম। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ডিজেল ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলার ছিল, সেটা এ বছরের জুনে ১৭১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।’

টিএই/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর