শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মেট্রোরেলের পিলারে ‘হাতির’ ধাক্কা!

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

Eli
মেট্রোরেলের দেয়ালে দেয়ালে নির্বাচনি পোস্টারে সয়লাব। ছবি- ঢাকা মেইল
দেয়াল-পিলারে পোস্টারে সয়লাব
পোস্টারে নষ্ট হচ্ছে শহরের সৌন্দর্য
চোখে পড়ছে বেশি ‘হাতি মার্কা’র পোস্টার
ভবিষ্যতের নেতৃত্বের দায়িত্বশীলতা নিয়ে শঙ্কা

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই রাজধানীর সড়ক ও অলিগলিতে পোস্টার-ফেস্টুনের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়নপ্রত্যাশীরা আইন অমান্য করে মেট্রোরেলের পিলার, ফ্লাইওভার এবং রাস্তার বিভিন্ন স্থানে নিজেদের ছবি এবং প্রতীক দিয়ে শহরকে নির্বাচনি মঞ্চে পরিণত করেছেন। শহরের দেয়াল, গ্রাফিতি এবং দেয়াল লিখন আংশিকভাবে ঢাকা পড়ছে। বিশেষ করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের চিহ্ন এবং বিপ্লবের গ্রাফিতি আর দেখা যায় না। এর মধ্যে বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি মনোনীত প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার কামাল হোসেনের হাতি মার্কা পোস্টারগুলো সবচেয়ে বড় এবং চোখে পড়ার মতো।


বিজ্ঞাপন


নগর পরিকল্পনাবিদরা জানিয়েছেন, এই ধরনের কর্মকাণ্ড শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে এবং তা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। পলিথিন, প্লাস্টিক এবং অন্যান্য অস্থায়ী উপকরণের মাধ্যমে শহরের দেয়াল এবং স্থাপত্য ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। এটি নির্বাচনি প্রচারণা হলেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

মতিঝিল থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, রিপাবলিকান পার্টিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের পোস্টার-ফেস্টুন রয়েছে মেট্রোরেলের পিলারে। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, নির্বাচনি মৌসুমে শহর পরিচ্ছন্ন থাকবে এবং নেতারা পরিবেশ রক্ষা করবেন- এমনটা আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পোস্টার-ফেসটুনের মাধ্যমে শহরকে নির্বাচনি মঞ্চে পরিণত করা হয়েছে।

2
মেট্রোরেলের দেয়ালে দেয়ালে নির্বাচনি পোস্টারে সয়লাব। ছবি- ঢাকা মেইল

শহরের বিভিন্ন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল পিলার এবং গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইওভারগুলোও বাদ যায়নি। পোস্টারগুলো এমনভাবে ঝুলানো হয়েছে যে, এতে গ্রাফিতি, আলপনা এবং দেয়াল লিখন ঢাকা পড়েছে। পোস্টারগুলো প্রায়ই বড় আকারের এবং চোখে পড়ার মতো রঙিন হওয়ায় শহরের দৃশ্যমান সৌন্দর্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নগরবাসী বলছেন, ভবিষ্যতের নেতা যদি নির্বাচনি প্রচারণায় এমন আচরণ করেন তবে নির্বাচিত হলে শহর পরিচালনায় তারা কতটা দায়িত্বশীল হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। নতুন বাংলাদেশ চাইলে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখাতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে নেতারা নিজেদের স্বার্থে সবকিছু কুৎসিত করে দিচ্ছেন। শহরের পরিবেশ, সৌন্দর্য এবং ইতিহাসবাহী স্থাপত্যের প্রতি তাদের যত্ন নেই।

তারা বলেছেন, নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতা এবং মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দায়িত্বশীল আচরণ দেখা উচিত। তারা আশা করেন, পোস্টার ফেস্টুনের মাধ্যমে শহরকে দূষিত করা বন্ধ হবে এবং শহরকে বাসযোগ্য রাখা হবে। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত ভোটের আগে শহরের সৌন্দর্য এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।

মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা রাফিকুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাজধানীর সড়ক ও অলিগলিতে পোস্টার-ফেস্টুন শহরের দৃশ্যমান সৌন্দর্য নষ্ট করছে। মেট্রোরেল পিলার এবং দেয়ালগুলোতে বড় বড় পোস্টার ঝুলানো হয়েছে। ভবিষ্যতের নেতা যদি নির্বাচনি প্রচারণায় এমন আচরণ করেন, তবে তারা শহর পরিচালনায় কতটা দায়িত্বশীল হবেন তা নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।’

প্রাইমারি শিক্ষক মমতাজ বেগম বলেন, ‘নির্বাচনি পোস্টার যত্রতত্র লাগানো নালা-নর্দমা, ফ্লাইওভার এবং স্থাপত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি শুধু সৌন্দর্য নষ্ট করছে না, বরং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। সিটি করপোরেশন যদি নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে পোস্টার স্থাপন এবং ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালায়, শহরের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে। জুলাই গ্রাফিতি ঢেকে দিলে মানুষের স্মৃতি ও আন্দোলনের স্পিরিটও হারাতে পারে।’

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, শহরের সড়ক এবং স্থাপত্যকে এই ধরনের নির্বাচনি ব্যানার, পোস্টার এবং ফেস্টুনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে তা পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে। নির্ধারিত স্থান ছাড়া পোস্টার এবং ফেস্টুন লাগানো নিয়মবিরুদ্ধ এবং আইনত দণ্ডনীয়। নগরবাসীও উদ্বিগ্ন যে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করলে শহরের চেহারা স্থায়ীভাবে বদলে যাবে।

তারা বলেছেন, এ ধরনের পোস্টার এবং ফেস্টুন যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে তবে শহরের সৌন্দর্য এবং পরিচ্ছন্নতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা আরও বলেছেন যে, নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহরের সড়ক এবং স্থাপত্য সংরক্ষণ করা জরুরি।

3
মেট্রোরেলের দেয়ালে দেয়ালে নির্বাচনি পোস্টারে সয়লাব। ছবি- ঢাকা মেইল

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা মানুষের মধ্যে কাজ করে এবং মানুষ ব্যাপকভাবে এই পোস্টারগুলো লাগায়। এখন যদি আমি নগরের কথা চিন্তা করে বলি, এগুলোর আসলে একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। এক সময় যখন সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট বা প্রযুক্তিগত দিকগুলো এত প্রসারিত ছিল না, তখন হয়তো এই ধরনের ব্যানার বা পোস্টার অনেক অর্থবহভাবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। মিডিয়ার নানা ধরনের প্ল্যাটফর্ম আছে, ইন্টারনেট আছে, আপনার মেসেজ পৌঁছানোর নানা উপায় আছে। তাই প্রচারণা করতে হলে এই ডিজিটাল মিডিয়াগুলো ব্যবহার করাই ভালো।’

তিনি সিটি করপোরেশনের কাছে প্রস্তাব রেখে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন সুনির্দিষ্ট জায়গায় এগুলো স্থাপন নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারে, যেখানে পোস্টার বা প্রচারণার উপকরণ লাগানো যায়। কিন্তু যত্রতত্র রাস্তাঘাটে এগুলো লাগানো এবং ভবিষ্যতে নানা ভোটের সময় এই অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। কেউ আবার পোস্টারের উপর পলিথিনও লাগায়। এগুলো নালা-নর্দমাকে ভরে দেয়। এটি পরিবেশগত দিক থেকে খুবই খারাপ। নালা-নর্দমায় পড়া প্লাস্টিক এবং পলিথিন ব্যাগ শহরকে নোংরা করে, যা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তাই এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। মানুষের কাছে যদি বার্তা পৌঁছাতে হয়, তা ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে ভালোভাবে পৌঁছে দেওয়া উচিত।’

জুলাই গ্রাফিতি ঢেকে পোস্টার টাঙ্গানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই গ্রাফিতিগুলো সারা বাংলাদেশে নানা স্থানে করা হয়েছিল। এর সঙ্গে মানুষের একটা অনুভূতি ও আবেগ জড়িত আছে। মানুষের আন্দোলন এবং তাদের আত্মত্যাগ নানা বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। জুলাই গ্রাফিতিগুলো যদি ঢেকে দেওয়া হয়, ধীরে ধীরে যারা মানুষকে স্মরণ করে, তাদের মনে করা হয় এবং সেই স্পিরিটের সঙ্গে সংযুক্ত খর্ব কিছুটা হলেও হারিয়ে যায়। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই।’

প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তারা পোস্টার সরানোর জন্য দলগুলোর কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে। নির্বাচন-প্রার্থী এবং তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের নামসহ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রশাসনের লক্ষ্য হচ্ছে শহরের দৃশ্যমান দূষণ কমানো এবং নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখা।

এদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশোধিত রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারে পোস্টার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, দু-এক দিনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধির গেজেট প্রকাশ করা হবে। নতুন বিধিমালায় বিগত নির্বাচনের তুলনায় বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আসছে। এরমধ্যে নির্বাচনি প্রচারে পোস্টার ও ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বিলবোর্ডে প্রচারের অনুমতি থাকবে—একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবে।

এএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর