- তোয়াক্কা নেই হাইকোর্টের নির্দেশের
- খেলাধুলার সুযোগ হারাচ্ছে শিশুরা
- খেলার জন্য ভাড়া ঘণ্টায় ৮ হাজার টাকা
- তৃতীয় পক্ষকে মাঠ ব্যবহারের অনুমতি
- এটা ইজারা দেওয়া অপরাধ: পরিবেশবিদ
রাজধানীর গুলশানের শহীদ তাজউদ্দিন পার্কটি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এক সময় যেখানে এলাকার শিশু-কিশোররা বিকেলে দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা করত এবং পরিবারের সঙ্গে বিনোদনে সময় কাটাত; এখন সেই সুযোগ আর অবারিত নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, পার্কের ফুটবল টার্ফে এখন খেলা হয় ঘণ্টায় আট হাজার টাকায়। সাধারণ মানুষের জন্য ফ্রিতে খেলার সুযোগ নেই।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন-ডিএনসিসি আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা অমান্য করে গুলশান ইয়ুথ ক্লাব ও গ্রিন সেভারর্স নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের হাতে পার্কের অংশ দখলের অনুমতি দিয়েছে। পরিবেশবিদ ও নাগরিক সংগঠনগুলো বলছে, বৃক্ষসেবার আড়ালে এই পার্কে চলছে ‘ব্যবসা ও দখল’। যার ফলে শিশু-কিশোররা বিনামূল্যে খেলাধুলা করতে পারছে না।
জানা গেছে, সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে পার্কের মাঠে ফুটবল টার্ফসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ এবং মাঠ ভাড়া দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পরও নতুন প্রশাসন সেই একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের পাশাপাশি গ্রিন সেভারর্স নামের নতুন একটি প্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। গণপূর্ত পার্কটি ডিএনসিসিকে হস্তান্তর করে এক চুক্তির মাধ্যমে। যেখানে বলা হয়, ডিএনসিসি কারো কাছে এটা হস্তান্তর করতে পারবে না। কিন্তু ডিএনসিসি পার্কটি ইয়ুথ ক্লাবের কাছে এক চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর করেছে। এই মাঠটা তৃতীয় পক্ষের কাছে ইজারা দেওয়ার পরে হাইকোর্টে রিট করা হয়। সেই রিটে বলা হয়েছিল, ডিএনসিসির কাছ থেকে এই ক্লাব যে মাঠটা দখল করেছে তাদের কাছে মাঠ দখলমুক্ত করতে হবে এবং যে ইমারতগুলো তারা স্থাপন করেছে সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। কিন্তু তারা হাইকোর্টের সম্মান করে এটা এখনো ক্লাবের কাছে বহাল রেখেছে। এছাড়া তারা আবারও চুক্তি নবায়ন করেছে।
২০০০ সালের ‘খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন’- অনুযায়ী, কোনো অবস্থাতেই এসব উন্মুক্ত স্থান ইজারা, ভাড়া বা অন্যভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু এই আইনের পরিপন্থীভাবে পার্কটি গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৯৫, ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে হাইকোর্টের তিনটি পৃথক রায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল-কোনো পার্ক বা খেলার মাঠে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো যাবে না এবং সব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। এসব রায় অমান্য করেই পার্কে স্থায়ী স্থাপনা, অফিস, ফুটবল টার্ফ ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন

অভিযোগ রয়েছে, পার্কে সাধারণ নাগরিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। মাঠে প্রবেশ করতে হলে ক্লাবের অনুমতি বা নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। এমনকি ক্লাবের সদস্য না হলে খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত থাকতে হয়। এতে করে শিশু ও সাধারণ মানুষ তাদের স্বাভাবিক অধিকার হারাচ্ছে। নথিপত্র অনুযায়ী, পার্কের মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে এবং ক্লাবের নামে স্থায়ী ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন আদালতের রায় কার্যকর না করে উল্টো তৃতীয় পক্ষকে মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। তাজউদ্দিন পার্কটি একসময় জনগণের বিশ্রাম ও শিশুদের খেলাধুলার জন্য নির্ধারিত ছিল, বর্তমানে অবৈধ দখল ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের কারণে তার মূল চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। বছরের পর বছর ধরে অভিযোগ, আন্দোলন ও আদালতের নির্দেশনা থাকলেও পার্কটি আজও মুক্ত হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের দখলের কারণে শিশু-কিশোরদের বিনামূল্যে খেলার স্থান হারিয়ে যাচ্ছে। তারা জানান, গত আগস্টে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে এ বিষয়ে অবহিত করা হলেও কোনো সমাধান হয়নি; বরং নতুন করে দখলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বৃক্ষসেবা ও ছাদবাগান কেন্দ্র স্থাপন অবশ্যই প্রয়োজনীয়, তবে তা কোনোভাবেই পার্ক বা খেলার মাঠের অভ্যন্তরে হতে পারে না। অবিলম্বে এসব অবৈধ চুক্তি বাতিল করে আদালতের নির্দেশনা অনুসারে মাঠ, পার্ক ও জলাধার ব্যবস্থাপনার দাবি জানিয়েছেন নাগরিকরা।
তারা বলছেন, মাঠ-উদ্যান-জলাধার রক্ষা আইনের ধারা ৫ অনুযায়ী এসব খোলা জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা বেআইনি। সুপ্রিম কোর্টও মাঠ ও পার্ক বাণিজ্যিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবু ডিএনসিসি আইন ও আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে গুলশান ইয়ুথ ক্লাব ও গ্রিন সেভারর্সের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
আলমগীর হোসেন নামের এক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, এই মাঠটা আগে সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এলাকার শিশু-কিশোররা প্রতিদিন এখানে এসে খেলাধুলা করত। কিন্তু এখন দেখা যায়, নির্দিষ্ট কিছু লোকই মাঠ ব্যবহার করতে পারে। বাইরে থেকে যারা আসে, তাদের কাছে ঘণ্টা হিসেবে টাকা নেওয়া হয়। এটা জনগণের মাঠ-এখানে কোনো ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা চলতে পারে না।
এদিকে পরিবেশবিদ ও নাগরিক সংগঠনগুলো দাবি করছে, ‘বৃক্ষসেবা ও ছাদবাগান সহায়তা কেন্দ্র’ স্থাপনের নামে পার্কে অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে ডিএনসিসি।

এ নিয়ে সম্প্রতি মাঠ, পার্ক, জলাধার দখলমুক্ত আন্দোলনের ব্যানারে দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে এসব অভিযোগ আনেন ১১ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এরমধ্যে রয়েছে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য, নগর পরিকল্পনাবিদ, বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, অ্যাডভোকেট, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক সংস্কৃতিকর্মী ও তথ্য অধিকার বিশেষজ্ঞরা। বিশিষ্টজনেরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ডিএনসিসির এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে এবং শহীদ তাজউদ্দিন পার্ক নাগরিকদের, বিশেষত শিশুদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করে দিতে।
মাঠ, পার্ক, জলাধার দখলমুক্ত আন্দোলনের সদস্য ইব্রাহিম খলিল ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রথমত এই মাঠটা জনগণের মাঠ। এখন আমরা চাই যে, জনগণের মাঠ জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এখানে নানা ধরনের সুবিধাবঞ্চিত শিশু আছে, কিন্তু তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। পাশাপাশি ওখানে যে টার্ফ বানানো হয়েছে, সেটি প্রতি ঘণ্টায় আট হাজার টাকা করে ভাড়া দেওয়া হয় এবং এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। পুরো টার্ফটাই অবৈধভাবে নির্মিত।
ইব্রাহিম খলিল বলেন, ওরা বলছে এখানে বিদ্যুৎ বিলসহ নানা কিছুর জন্য টাকা দরকার হয়, কিন্তু সেটা তো সরকার দেবে। সেখানে প্রতিদিন নানা ধরনের দল এসে টাকা-পয়সা দিয়ে খেলা করছে। অথচ এটা তো সর্বসাধারণের মাঠ ছিল। তারা এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে কাজ করছে। সেখানে সাধারণ মানুষজন এখন আর খেলতে পারে না।
আরও পড়ুন:
মাঠ, পার্ক, জলাধার দখলমুক্ত আন্দোলনের এই সদস্য বলেন, এই টাকাটা মূলত নিচ্ছে ইউথ ক্লাব। সব ধরনের কার্যক্রম ডিএনসিসি তাদের সেই এখতিয়ার দিয়ে রেখেছে। ডিএনসিসি এখন ইজারার দায়িত্বও ইউথ ক্লাবকে দিয়ে দেখভাল করাচ্ছে। শুধু অনিয়ম নয়, এখানে দুর্নীতিরও ঘটনা ঘটেছে। আমাদের কাছে কিছু প্রমাণ রয়েছে। আমরা অচিরেই ইউথ ক্লাবের ওই টিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জানাবো এবং একই সঙ্গে ডিএনসিসির বিরুদ্ধেও অভিযোগ দাখিল করব।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা জনগণের সম্পত্তি, কাউকে ভাড়া দেওয়া বা ইজারা দেওয়া যায় না, এটা স্পষ্টতই অপরাধ। আর এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। ২০০০ সালের জনস্বার্থ সংরক্ষণ আইনে বলা আছে, কোনো অবস্থাতেই পার্কগুলো ইজারা বা ভাড়া দেওয়া যাবে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি করপোরেশন কীভাবে এসব পার্ক জনসাধারণের পরিবর্তে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেয়? এটা তারা করতে পারে না।’
এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘এমনকি এত বড় একটি গণঅভ্যুত্থানের পরেও করপোরেশনের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। এখনো আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে, বিবৃতি দিতে হচ্ছে, বারবার লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু কেন? কেন নাগরিকদের নিজেদের অধিকারের জন্য এমন সংগ্রাম করতে হবে? করপোরেশন তো সরকারি সংস্থাই। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন-রাষ্ট্রের অন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, যারা এসব বিষয় দেখভাল করার দায়িত্বে আছেন, তারা কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? সর্বোপরি, মনে হচ্ছে পুরো সিস্টেমটাই এই অপরাধগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আগে এক দল দখল করত, এখন আরেক দল গিয়ে দখল করে। এই দখল ও অনিয়মের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিশুরা- যাদের খেলা ও বিনোদন একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার। একজন শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খেলাধুলা, সামাজিক মেলামেশা, মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক বিকাশ অপরিহার্য। কিন্তু এসব অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বারবার আওয়াজ তুলেও কোনো স্থায়ী সমাধান মিলছে না। কর্তৃপক্ষ একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে, আর এই অবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলছেই।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এধরনের কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। ডিএনসিসির পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কাশেম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এবিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে পারবো না। জনসংযোগ কর্মকর্তাও কাছে খোঁজ নিতে পারেন। এমন কোনো বিবৃতি দিয়েছেন কি না সেটাও আমি জানি না।’
এ বিষয়ে জানতে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার সঙ্গে বারবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এএইচ/জেবি

