পুরান ঢাকা মানেই এক স্বতন্ত্র জীবনধারা সঙ্কীর্ণ গলি, পুরোনো ভবন, জমজমাট বাজার, ঐতিহ্যের ঘ্রাণ আর মানুষের আন্তরিকতা। এই পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্থাপত্য-ঐতিহ্যের অনবদ্য নিদর্শন তারা মসজিদ। শত বছরের বেশি পুরোনো এই মসজিদ শুধু ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকার কৃষ্টি, সৌন্দর্যবোধ, আধ্যাত্মিকতা ও শিল্প-নন্দনের প্রতীক। মসজিদের নীল-সাদা তারাখচিত নকশা, সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং ইতিহাস বহু মানুষের চোখে ও মনে মুগ্ধতার ছাপ রেখেছে যুগের পর যুগ।
তারা মসজিদকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রা, স্মৃতি, আনন্দ, দুঃখ, মিলনমেলা ও হৃদয়ের টান গড়ে উঠেছে। এখনও প্রতিদিন শত শত মানুষ নামাজ পড়তে, মসজিদের সৌন্দর্য দেখতে বা কেবল কিছুক্ষণ নিরিবিলিতে বসে থাকার জন্য এই মসজিদে আসেন। কোনো কোনো দিন বিদেশি পর্যটকের ভিড়ও চোখে পড়ে।
বিজ্ঞাপন
এই প্রতিবেদনে তারা মসজিদের ইতিহাস, স্থাপত্য, পরিবেশ, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং পাঁচজন মুসল্লি ও এলাকাবাসীর ব্যক্তিগত অনুভূতি তুলে ধরা হলো।

ইতিহাস: ছোট একটি মসজিদ থেকে ঐতিহ্যের প্রতীক
তারা মসজিদের নির্মাণকাল নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। মসজিদের গায়ে এর নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না। তবে জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার ‘মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ’-এ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে, ১৯২৬ সালে, ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে।
বিজ্ঞাপন
মোঘল স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব রয়েছে এ মসজিদে। ঢাকার কসাইটুলীর মসজিদেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। উল্লেখ্য, দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরের সতের শতকে নির্মিত স্থাপত্যকর্মের ছাপ পড়ে মোঘল এই স্থাপত্য শৈলীতে।
মসজিদটি ধীরে ধীরে একটি আকর্ষণীয়, আলোকোজ্জ্বল, নান্দনিক স্থাপনায় রূপ নেয়। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে। এই সময় মসজিদের দেয়াল, গম্বুজ, মিনার ও ভেতরের প্রায় সব জায়গায় টুকরো টুকরো টাইলস দিয়ে নকশা করা হয়। এসব নকশায় তারা আকৃতি ব্যবহার করায় এর নাম হয় তারা মসজিদ বা স্টার মসজিদ।
যেসব টাইলস ব্যবহৃত হয়েছে, তার অনেকগুলোর নকশায় জাপানি, ইউরোপিয়ান ও মধ্যপ্রাচ্যের কারুকাজের প্রভাব দেখা যায়। বলা হয়, সেই সময় বিদেশ থেকে বিশেষভাবে টাইলস এনে মসজিদ সাজানো হয়েছিল। পুরান ঢাকায় এমন টাইলস ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বিরল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদটি পুরান ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পরিণত হয়। বহু মানুষের কাছে এটি এখন শুধু নামাজের জায়গা নয় বরং এটি ঐতিহ্য, স্মৃতি ও শিল্পকলার এক যৌথ ধারক-বাহক।
স্থাপত্য: নীল–সাদা তারাখচিত স্বপ্নলোক
তারা মসজিদের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার এক অনন্য সৃষ্টি। এটি বড় মসজিদ নয়, তবে যেখানে যেমন সৌন্দর্য প্রয়োজন সবই যেন সূক্ষ্মভাবে গড়ে দেওয়া হয়েছে।

গম্বুজ ও বাইরের নকশা
মসজিদে মোট পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে তিনটি বড়, দুইটি ছোট। গম্বুজগুলোর সাদা পটভূমিতে নীল তারা, ফুল, জ্যামিতিক রেখা ও মোজাইকের সমন্বয়ে এক পরাবাস্তব সৌন্দর্য এনে দেয়। দূর থেকে তাকালে মনে হয় আকাশের নক্ষত্রগুলো যেন গম্বুজের বুকে নেমে এসেছে।
টাইলস শিল্পের রূপমহিমা
মসজিদের দেয়াল, খিলান, অভ্যন্তরীণ গম্বুজ, মেহরাব প্রায় প্রতিটিতেই ব্যবহৃত হয়েছে হ্যান্ডক্রাফটেড টাইলস। এসব টাইলসের নকশায় ফুটে ওঠে জাপানি শিল্পরীতি, ইউরোপীয় ফুল-লতার ছাপ, মধ্যপ্রাচ্যের জ্যামিতিক নকশার অনুসরণ।
এই তিন ধাঁচ একত্রে তারা মসজিদকে পরিণত করেছে এক অনন্য বৈশ্বিক শিল্প-উদাহরণে।
ভেতরের পরিবেশ
ভেতরে পা রাখা মাত্রই নীল-সাদা আলোয় এক শান্ত পরিবেশ অনুভূত হয়। মসজিদের মেঝে ঝকঝকে, বিন্যাস সিমেট্রিক্যাল, মেহরাবদুটি জটিল নকশায় মোড়া। নীরবতা, আলো, সাদা-নীলের সমন্বয় যেন হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়।
উঠান ও আশপাশ
মসজিদের সম্মুখ উঠানটি আধুনিককালে সংস্কার করা হলেও পরিচ্ছন্নতা ও প্রশস্ততার জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত। নামাজের সময় ছাড়া অনেকেই এখানে বসে বিশ্রাম নেন, কেউ কোরআন পড়েন, কেউবা পরিবার নিয়ে একটু নিরিবিলি সময় কাটান।

তারা মসজিদ বারান্দা
মির্জা গোলামের সময় মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজঅলা, দৈর্ঘ্যে ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার) আর প্রস্থে ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার)। আলী জানের সংস্কারের সময়, ১৯২৬ সালে, মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ করা হয়। পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটো গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়।
মসজিদের বতর্মান দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)।
এলাকার মানুষের জীবন ও তারা মসজিদ
পুরান ঢাকায় যেমন মানুষের ঘনবসতি, তেমনই আন্তরিকতা ও সামাজিক বন্ধনের জায়গা। তারা মসজিদকে কেন্দ্র করে আরমানিটোলায় বহু ধরনের সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এখানে প্রতিদিন ফজর থেকে এশা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। অধিকাংশ মানুষই প্রতিদিন কোনো না কোনো সময় নামাজ পড়তে আসেন। অনেকে আবার বিকেলে বা রাতে শুধু কিছু শান্ত সময় কাটাতে আসেন।
মসজিদের সামনে ছোট দোকান, চায়ের টং, পানের দোকান, বইয়ের দোকান সব মিলিয়ে ব্যস্ত একটি পরিবেশ। অনেক দোকানির মতে, তারা মসজিদ থাকার কারণেই এই এলাকাটি সবসময় জীবন্ত থাকে।
শিক্ষক আবদুল কাইয়ুম (৫৮) বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই এই মসজিদে নামাজ পড়ি। এই মসজিদ আমার কাছে শুধু নামাজের জায়গা নয়, আমাদের জীবনের একটা অংশ। এখানে এলে মনটা শান্ত হয়ে যায়। এত সুন্দর আর সুশৃঙ্খল পরিবেশ পুরান ঢাকায় খুব কম জায়গায় পাওয়া যায়।’
নাসির উদ্দিন (৩০) নিয়মিত মুসল্লি, তিনি বলেন, ‘আমি অন্য এলাকায় থাকি, তবুও শুক্রবারের নামাজ পড়তে এখানে চলে আসি। কারণ এর ভেতরের সৌন্দর্য আমাকে খুব টানে। মসজিদে ঢুকলেই মনে হয় অন্য এক জগতে চলে এসেছি। নীল তারাগুলো যেন চোখে প্রশান্তি এনে দেয়।’
শাহেদা বেগম (৪৫) বলেন, ‘আমার বাবা-দাদারা এই মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি ছিলেন। আমরা ছোটবেলায় এখানে ঈদের জামাত পড়েছি, খেলেছি, অনেক স্মৃতি আছে।’
শিক্ষার্থী রাব্বি (২২) বলেন, ‘আমি আর্কিটেকচার নিয়ে পড়ছি। তাই যখন প্রথম এখানে আসি, স্থাপত্য দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। এত পুরোনো একটি স্থাপনায় এমন মোজাইক আর জাপানি টাইলসের কাজ সত্যিই অসাধারণ! বাংলাদেশের ঐতিহ্য বুঝতে তারা মসজিদ ঘুরে দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
দোকানদার মো. হামিদ (৩৮) বলেন, ‘মসজিদের কারণে আমাদের দোকানের ব্যবসা ভালো থাকে। মানুষ আসলেই এখানে আসে। তবে সবচেয়ে ভালো লাগে মসজিদের পরিবেশটা। যেকোনো সময় গেলে অন্তত পাঁচ-দশজন মানুষকে দেখতে পাবেন কেউ নামাজ পড়ছে, কেউ কোরআন পড়ছে, কেউ বসে আছে শান্তিতে।’

পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে তারা মসজিদ
পুরান ঢাকা বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও তারা মসজিদ আগের মতোই শ্রদ্ধা, সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে টিকে আছে। পুরান ঢাকার বিখ্যাত ইফতার, ঐতিহাসিক বাড়ি, সরু গলি সবকিছুর সঙ্গে মানানসই এই মসজিদ স্থানীয়দের কাছে গর্বের জায়গা।
প্রতি বছর বহু বিদেশি পর্যটকও আসে। তাদের অনেকে বলে থাকেন, এটি ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনা। বিশেষ করে যারা ইসলামিক আর্ট ও আর্কিটেকচার নিয়ে আগ্রহী, তারা মসজিদটি দেখে বিশেষভাবে মুগ্ধ হন। কিছু ইউরোপীয় পর্যটক এমনও বলেছেন এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছোট মসজিদগুলোর একটি।

ভবিষ্যৎ ও সংরক্ষণ চ্যালেঞ্জ
তারা মসজিদ এখনও অত্যন্ত সুন্দর ও আকর্ষণীয় হলেও সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। পুরান ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাস্তার সংকট, পরিবেশগত পরিবর্তন সবই ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। কিছু স্থানে পুরোনো টাইলস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে; অনেক জায়গায় আরও গবেষণাভিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
স্থপতি, বিশেষজ্ঞ এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা মনে করেন মসজিদটিকে যথাযথ সংরক্ষণ করা গেলে এটি বিশ্বের ইসলামিক স্থাপত্য ইতিহাসে একটি বিশেষ জায়গা করে নিতে পারে।
তারা মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় নিদর্শন নয়— এটি পুরান ঢাকার আত্মা, স্মৃতি, শিল্প, ঐতিহ্য ও মানুষের অনুভূতির এক অনন্য মেলবন্ধন। নীল–সাদা তারাখচিত কারুকাজের দিকে তাকালে মনে হয়— এ যেন কেবল স্থাপত্য নয়, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার এক নীরব কবিতা।
পুরান ঢাকার মানুষ, মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি, দোকানদার, শিক্ষার্থী— সবার জীবনেই এই মসজিদ কোনো না কোনোভাবে জায়গা করে নিয়েছে। সময় যতই যাক, তারা মসজিদের ঝলমলে নীল তারাগুলো যেন পুরান ঢাকার হৃদয়ে আলো ছড়িয়ে যেতে থাকবে বহু বছর।
এম/এফএ

