মোঘল সম্রাট ও তাদের উচ্চপদস্থ আমলারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ইমারত, মসজিদ ও স্থাপনা নির্মাণ করেন যা আজও স্থাপত্যশিল্পের বিরল ও উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে বিরাজমান। আধুনিককালেও সেসব নিদর্শনের কাছে হার মেনে যায় বর্তমান অনেক স্থাপনা। তেমনি একটি মোঘল স্থাপনা বজরা শাহী মসজিদ। আধুনিককালে নির্মিত না হলেও কোনও আধুনিকতার কমতি নেই এই মসজিদে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং ঢাকা-নোয়াখালী পাকা রাস্তা থেকে ৩ শ’ মিটার পশ্চিমে ঐতিহাসিক এই মসজিদটি অবস্থিত।
জানা যায়, প্রায় ২শ’ ৮১ বছর আগে মোঘল মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে তার নির্দেশে ও অর্থায়নে মিয়া আম্বরের সহযোগিতায় জমিদার আমান উল্যা খান কর্তৃক ১৭৪১ সালে দিল্লির শাহী মসজিদের অনুকরণে নির্মিত হয় বজরা শাহী জামে মসজিদ। যা আজও মোঘল সাম্রাজ্যের স্মৃতি বহন করে চলছে।
বিজ্ঞাপন
অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এই মসজিদটিতে বিভিন্ন রঙের পাথর, চীনা মাটির তৈরি তৈজসপত্রের খণ্ডিত অংশের ব্যবহার আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। মসজিদের বহুভাঁজ খিলানের কোণায় ফুল ও নকশা, আয়তকার খোপের মধ্যে খিলান নকশা, আয়তকার উপরিভাগে পাতা নকশা, পাতার নকশার ওপরে দড়ির মতো গোলাকার বাঁধনের খোপে ফুল ও লতার নকশা রয়েছে। এছাড়া দরজায় আয়তকার খোপের ওপর তারা ও বরপি নকশা, টারেটর গায়ের জেব্রাক্রসের মতো নকশা, বিভিন্ন রঙের পাথর ও তৈজসপত্রের খণ্ডিত অংশের সংমিশ্রণ করা হয়েছে।
মসজিদটির গম্বুজের গায়ে চাঁদ-তারা ও পাখা নকশা ছাড়া গম্বুজের একবারে ওপরের দিকে পদ্মের পাপড়ি নকশা ও লম্বা চূড়াতে কলসির মতো ধাতব বস্তু স্থাপন করে গম্বুজগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। অষ্টভূজাকৃতি কর্ণার টাওয়ারে মোটা দড়ির মতো বাঁধনের সাহায্যে ঘূর্ণায়মান আয়তাকার খোপ নির্মাণ করে প্রত্যেক বাহুর খোপের ভেতরে অন্ধখিলান (ব্লাইন্ড আর্চ) নকশা, খিলানের ভেতরে বিভিন্ন প্রকারের ফুলদানি নকশা, তারা নকশা দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। চত্বরে সামনের দিকে প্রধান ফটেকের দু’পাশে ও মিনারের মসজিদের মতো বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার ছাড়াও ডোরা কাটা নকশা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অভূতপূর্ব স্থাপত্যকলায় নির্মিত এই মসজিদ পরিদর্শন করতে দূর-দূরান্ত থেকে বহু সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ বজরায় আসেন।
মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য তিনটি পাথরের দরজা আছে। মধ্যবর্তী প্রধান দরজাটি তুলনামূলক বড়। এর সম্মুখভাগ তিনটি অংশে বিভক্ত। মসজিদের মধ্যবর্তী স্থানের দেয়াল সামনের দিকে বাড়ানো। এই বাড়ানো দিকের মধ্যবর্তী অংশে ২ দশমিক ১৩ মিটার প্রশস্ত অর্ধবৃত্তাকৃতির ১টি বহুভাঁজ খিলান রয়েছে। মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের দু’দিকে দু’টি দরজা প্রধান প্রবেশ পথের মতো হলেও ছোট আকৃতির। দরজায় উপরিভাগে আয়তকার খোপের মধ্যে সাদা পাথর বা চীনা মাটির তৈরি আরবী বর্ণমালার লেখা ‘লা-ই-লাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাাদুর রাসুলুল্লাহ’।
মসজিদের চারকোণে চারটি অষ্টভূজাকৃতি কর্ণার টাওয়ার রয়েছে। কর্ণার টাওয়ারকে দড়ি নকশা মাধ্যমে বাঁধন সৃষ্টি করে কয়েকটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। বাঁধনের ভেতর আয়তকার খোপের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অন্ধখিলানের ব্যবহার রয়েছে। কর্ণার টাওয়ারের ওপরের অংশ কিছুটা সরু করে এই খিলানের এক দশমিক ২২ মিটার ভেতরে পাথরের মূল দরজাটি তৈরি হয়েছে। বহুভাঁজ খিলানটি একটি আয়তকার খোপের মধ্যে নির্মিত। এই খিলানের উভয়পাশে আয়তকার খোপের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অন্ধখিলান রয়েছে। খিলানের ওপর দিকে মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে শিলালিপি।
বিজ্ঞাপন
মসজিদের সামনেরে দিকে বাড়ানো অংশের দু’প্রান্ত সীমায় অষ্টভূজাকৃতি কর্ণার টারেট ক্রমশ সরু হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। কর্ণার টারেটের নিচের দিকে অনেকটা ফুলের টবের মতো নির্মিত। মনে হয় টারেটগুলো টবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গম্বুজাকৃতি চূড়া তৈরি করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকের মধ্যবর্তী অংশের বের হয়ে আসা জায়গায় কোণাকৃতির দুটি পাথরের দরজা রয়েছে। দরজার দু’পাশে রয়েছে টারেট। মসজিদের পশ্চিমাংশের বাইরের দিকেও এর সম্মুখভাগের মতো নির্মিত। মসজিদের ওপরের দিকে সারিবদ্ধ রয়েছে ৩টি গম্বুজ। মধ্যবর্তী গম্বুজটি তুলনামূলকভাবে বড়। প্রত্যেকটি গম্বুজ অষ্টাভূজাকৃতি।
মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে পাকা চত্বর। চত্বরের পূর্বপাশে বহুভাঁজ খিলানযুক্ত প্রধান ফটক রয়েছে। প্রধান ফটকের সামনের দিকে উত্তর ও দক্ষিণ দিক। সম্প্রসারণ করে টারেট নির্মাণ করা হয়েছে। টারেট ও ফটকের মধ্যবর্তী স্থানে বিভিন্ন প্রকার অন্ধকার খিলানযুক্ত কুলঙ্গি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রসারিত অংশে অন্ধখিলান ও সামনের দিকের দু‘প্রান্তে দুটি উঁচু টাওয়ার রয়েছে। প্রধান ফটকের ঠিক উপরিভাগে আয়তকার নির্মাণ কাঠামো রয়েছে। এই নির্মাণ কাঠামোর চার কোণে চারটি টারেট রয়েছে।
মসজিদের আজান দেয়ার জন্যে এই নির্মাণ কাঠামোর মধ্যবর্তী স্থানে অষ্টভুজাকৃতি মিনার নির্মিত হয়েছে। মিনারটি দেখতে অনেকটা ছাতার মতো। মিনারের প্রত্যেক বাহুর কোণায় টারেটগুলো ক্রমশ সরু হয়ে ওপরে উঠে গেছে। মিনারের চারদিকে চারটি কৌণিক খিলান রয়েছে এবং সেগুলোর ওপরে ছোট গম্বুজ তৈরি করা হয়েছে।
বজরা মসজিদের স্থাপত্যগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে— বহুভাঁজ ও কৌণিক খিলানের ব্যবহার ছাড়াও আয়তকার খোপের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের খিলানের ব্যবহার, মসজিদের কোণায় ও মধ্যবর্তী স্থানে টাওয়ার ও টারেটের ব্যবহার, টারেটের নিচের দিকে ফুলের টবের মতো পাদদেশ নির্মাণ, অষ্টাভুজাকৃতি পিলারের ওপর গম্বুজ নির্মাণ। জানা যায়, মসজিদটি তৈরির ১৭৭ বছর পর ১৯০৯ সালে একবার মেরামত করা হয়।
মসজিদের ঘেরার মধ্যে দক্ষিণ পূর্ব কোণে আমান উল্যাহ ও সানা উল্যাহ ভ্রাতৃদ্বয় এবং তাদের মায়ের কবর রয়েছে। বাদশা শাহ-এর একান্ত আগ্রহে মক্কা শরীফের বাসিন্দা তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বজুর্গ আলেম হযরত মাওলানা শাহ আবু বকর সিদ্দিকী সাহেব এই মসজিদের সর্বপ্রথম ও প্রধান ইমামের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর নিকটতম পুরুষগণই যোগ্যভিত্তিক তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে অধ্যবধি ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সপ্তম ইমাম হাছান সিদ্দিকী বর্তমানে ইমামের দায়িত্বে রয়েছেন।
বর্তমানে ইমামের দায়িত্বে থাকা ইমাম হাছান সিদ্দিকী জানান, প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ মসজিদ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। এছাড়া মসজিদ পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে প্রতি বছর এর বিভিন্ন সংস্কার কাজ করা হয়। ইতোমধ্যে সীমানা প্রাচীর দেয়া হয়েছে এবং তাতে টাইলস বসানোর কাজ হয়েছে। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে মসজিদটিকে। নারীরা যাতে পর্দার সাথে নামাজ পড়তে পারে তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে মুসল্লীদের দীর্ঘদিনের দাবি মসজিদে মূল প্রবেশ দ্বারে একটি গেইট নির্মাণের। যা বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনাথীরা এ মসজদির পরিদর্শনে আসেন, অনেকেই বিভিন্ন মানত পূরণে আসেন। মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকজন এ মসজিদে মানত পূরণ করতে আসেন বলেও জানা গেছে।
এএ

