রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা বহু দিনের পুরনো। শহরের সড়কব্যবস্থার অস্থিতিশীলতা, ট্রাফিক সিগন্যালের অব্যবস্থাপনা এবং ম্যানুয়াল ত্রুটির কারণে যানজটের সমস্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। এই সমস্যার সমাধানে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও তেমন কার্যকর ফলাফল পাওয়া যায়নি। গত ৩০ আগস্ট এই সমস্যা মোকাবিলায় ঢাকা শহরে সিগন্যাল সিস্টেমে অটোমেশন ব্যবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে।
এই সিস্টেমের মূল উদ্দেশ্য হলো সিগন্যালের সময় নির্ধারণ ও পরিবর্তনকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালনা করা, যাতে কোনো ভুল না ঘটে এবং যানজট কমানো যায়। তবে নতুন সিস্টেমটি কতটা কার্যকরী হবে, সেটা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সিগন্যাল সিস্টেমের অটোমেশন ব্যবস্থার প্রবর্তন মূলত সিগন্যালের সময় নির্ধারণের ওপর ভিত্তি করে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে সিগন্যালের সময় নির্দিষ্ট ও নির্ভুল হওয়ায়, পথচারী এবং যানবাহন চালকরা পূর্বানুমান করতে পারবেন এবং সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতার অনুভব করতে পারবেন। এর ফলে, সড়কে যানজটের পরিমাণ কমে যাবে। যানবাহনগুলো নির্দিষ্ট সময় পর সিগন্যাল পার হয়ে যাবে, যা একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। অতীতে সিগন্যালের সময় অনিয়মিতভাবে পরিবর্তন হয়ে আসছিল, কিন্তু এখন সিস্টেমটি আরও সুনির্দিষ্টভাবে সিগন্যালের সময় নির্ধারণ করবে, যার ফলে যানবাহনগুলো সময়মতো চলতে পারবে।

তবে, নতুন সিস্টেম চালু হলেও কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। সিগন্যালের সঠিক এবং নির্ভুলতার ক্ষেত্রে কিছু জায়গায় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। কিছু সিগন্যালের পরিবর্তন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরি হচ্ছে, যা চালক এবং পথচারীদের জন্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে। বিশেষত, রাতে সিগন্যালের দৃশ্যমানতা বা আলোকব্যবস্থার সমস্যা রয়েছে, যা সঠিকভাবে কাজ না করলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এই প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো স্থায়ীভাবে সমাধান করা গেলে সিস্টেমের কার্যকারিতা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অটোমেশন সিস্টেম চালু হওয়ার পর ট্রাফিক পুলিশও তাদের কাজের গতি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের কাজ এখন আর পুরোপুরি পুলিশের ওপর নির্ভরশীল নয়, ফলে তারা সড়কের অন্যান্য নিরাপত্তা কার্যক্রমে মনোযোগ দিতে পারছেন। সিস্টেমের মধ্যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে পুলিশের জন্য তা দ্রুত সমাধান করা জরুরি, যাতে সড়ক নিরাপত্তা বজায় থাকে এবং দুর্ঘটনা কমানো যায়। তবে সিস্টেমের প্রাথমিক পরীক্ষামূলক কাজগুলোর পর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে এটি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া, সিগন্যাল সিস্টেমের অটোমেশন চালু হওয়া সত্ত্বেও কিছু মানুষের মধ্যে এই সিস্টেমের প্রতি আস্থা কম থাকতে পারে। কিছু চালক এখনো অটোমেশন সিস্টেমের পরিবর্তন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাননি এবং সেটিকে ঠিকমতো অনুসরণ করছেন না। যদিও সিস্টেমটি কার্যকর হলে, সিগন্যাল অমান্য করার মতো অপরাধ আর সহনীয় হবে না এবং যারা সিগন্যাল অমান্য করবেন তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে। তাতে সড়ক শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন মানার সচেতনতা বাড়বে।

জানা গেছে, ঢাকার সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর জন্য ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৭০টি জায়গায় আধুনিক সিগন্যাল বসানোর কাজ শুরু হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ২০১১ সালে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯২টি মোড়ে সোলার প্যানেল ও সিগন্যাল সিস্টেম বসানো হয়, কিন্তু সেগুলোও স্থায়ী হয়নি। ২০১৫ সালে ডিটিসিএ এবং জাইকার সহযোগিতায় গুলশান, মহাখালী, পল্টন, ফুলবাড়িয়া মোড়ে আইটিএস (ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম) স্থাপন করা হলেও সেগুলোর কার্যকারিতা দেখা যায়নি।
২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে ট্রাফিক সিগন্যালের অটোমেশন পদ্ধতি চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে সাত বছর পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানেও ঢাকার সড়কে নতুন সংকেতবাতি বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে খোদ প্রকৌশলীরা মনে করছেন, এসব সিগন্যালের প্রযুক্তি পুরনো এবং এতে যান্ত্রিক ত্রুটির আশঙ্কা রয়েছে।
তবে নাগরিকদের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। আলাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ঢাকার ২২টি মোড়ে নতুন করে ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট বসানো হয়েছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এসব বাতি বসাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। আজ সকালে দেখলাম, এই বাতি কোনো কাজে আসছে না।

আব্দুল আজিজ নামের এক পথচারী বলেন, আজ বিমানবন্দর যাচ্ছিলাম, দেখলাম সবাই রেড সিগন্যাল অমান্য করছে। ড্রাইভারদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা কোনো উত্তর পেল না। সিগন্যালের কার্যকারিতা নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা নেই।
রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের জাতি হিসেবে সচেতনতা কম, তাই আইন মানানোর জন্য বাধ্যবাধতা প্রয়োজন। প্রতিটি সিগন্যালের কাছে পুলিশের উপস্থিতি থাকলে এবং লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জরিমানা করলে ফলাফল অনেক ভালো হতো। বুয়েটকে ধন্যবাদ, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে আমাদের দায়িত্ববোধ ও আইন মানার মানসিকতা উন্নয়ন করতে হবে।
একজন পথচারী বলেন, সিস্টেমটি এমনভাবে করা যায় যাতে সিগন্যাল অমান্য করলে অটোমেটিক গাড়ির নম্বর ক্যামেরায় শনাক্ত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে মামলা হয়ে যায়। মেসেজ ফোনে চলে গেলে আইন আরও কার্যকর হবে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ঢাকার যানজট সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে শহরের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যা সমাধানে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যকর ফলাফল পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে ট্রাফিক সিগন্যালব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যর্থতা শহরের যানজট বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফ্রিকার একটি দেশের রাজধানীতে যেমন স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থার কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে, তেমনি ঢাকায় প্রতি মুহূর্তে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য হাতের ইশারা এবং লেজার রশ্মির ব্যবহার হচ্ছে, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক সিগন্যালব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ হলো সমন্বয়ের অভাব। পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাবে প্রতিটি প্রকল্প ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য সঠিক সমন্বয়, পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্ব পুলিশে দেওয়া হলে সড়ক নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা আরও উন্নত হবে। তবে পুলিশ বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। ঢাকার সড়কে যানবাহনের গতি, সংখ্যা এবং অবস্থা মিশ্রিত হওয়ায় সিগন্যাল ব্যবস্থার কার্যকরী প্রয়োগ আরও জটিল। তাই, একটি সমন্বিত ও কার্যকরী ট্রাফিক সিস্টেম বাস্তবায়নে গভীর গবেষণা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন।
ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই প্রকল্পটি শুধু শহরের যানজট কমানোর জন্য নয়, বরং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আনার উদ্দেশে নেওয়া হয়েছে। সিগন্যাল অটোমেশন সিস্টেম চালু হওয়ার পর, ট্রাফিক পুলিশ তাদের কাজের গতি বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। কারণ সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের কাজ এখন আর তাদের একার দায়িত্ব নয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-অ্যাডমিন, প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ) মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাদ দিয়ে এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিভিন্ন মামলা করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে প্রায় ২৩ ধরনের মামলা ডিটেক্ট করা যায়। সেখান থেকে ট্রাফিক অমান্য করা, সিগন্যাল বন্ধ করে দেওয়া বা রাস্তা ব্লক করা, যাই হোক না কেন আমরা ডিজিটাল মাধ্যমে শনাক্ত করতে পারি।’

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে অনেক ভিডিও মামলা করা হচ্ছে দূর থেকে ফুটেজের মাধ্যমে। অনেকেই বুঝতে পারছেন না কীভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। আগামীতে অবশ্য আইন অমান্যকারীদের বাসায় চিঠি পৌঁছে যাবে। এছাড়া যে মামলাগুলো করা হয়, সেগুলোর ভিডিও ফুটেজ বা সিসিটিভি ফুটেজ প্রমাণ হিসেবে রাখা হয়, যাতে তারা সেটার প্রমাণ পায়।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক ইজাজ আহমেদ জানিয়েছেন, নগরবাসী ধীরে ধীরে স্মার্ট ট্রাফিক সুবিধার সুফল পাচ্ছেন। তিনি জানান, এই স্মার্ট সিস্টেমগুলো গুলশান থেকে তেজগাঁও হয়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী মাসে টেন্ডারিং কার্যক্রম শুরু হওয়ার আশা থাকছে, আর তিন থেকে চার মাসের মধ্যে পুরো করিডোরের কাজ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, ‘এক সময় ঢাকায় লাইভ ট্রাফিক ব্যবস্থা ছিল না। পরে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারদের সহযোগিতায় সেমি ট্রাফিক লাইটিং সিস্টেম চালু করা হয়, যা থেকে ইতোমধ্যেই মোটামুটি ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে।’
প্রশাসক বলেন, ‘আমরা জনগণের প্রতি বিশ্বাস রাখি। লাল লাইট জ্বললে থামবে, সবুজ জ্বললে চলবে। মানুষ এই অভ্যাস গড়ে তুললেই ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। যেহেতু সবাই এখনো এই ব্যবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি অভ্যস্ত নয়, তাই একটু সময় লাগতে পারে।’
এএইচ/জেবি

