গত ৩১ আগস্ট (রোববার) বিকেল ৫টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে বসিলা ৪০ ফিট-চন্দ্রিমা সাঁকোর পাড়ে আসেন রবিউল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, আমি ভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তা মোড়ে এসে নামি। সেখান থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে আমার বাসার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়ে বসিলা চল্লিশ ফিট সাঁকোর পাড়ে আসি। রিকশা থামার পর ভাড়া দেব এমন সময় দুজন লোক মাক্স পরা অবস্থায় ধারালো অস্ত্র নিয়ে এসে আমাকে প্রথমে মারধর করে। এরপর এদের একজন আমার গলায় অস্ত্র ধরে বলে, যা আছে দিয়ে দে। না হয় জবাই করে ফেলব।
ওই ভুক্তভোগী বলেন, তখন আমি বলি- আমি ক্লাস করে এসেছি, আমার কাছে কিছু নেই। তখন তারা আমাকে অস্ত্রের উল্টা পিঠ দিয়ে পায়ে আঘাত করে বলে, আমার কাছে মোবাইল, টাকা-পয়সা যা আছে সব তাদের দিয়ে চুপচাপ চলে যেতে। আমি ভয়ে আমার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দিয়ে দিই। দেখাই যে আমার কাছে পঞ্চাশ টাকা আছে। সেই টাকা তাদের রিকশা ভাড়া দিতে বললে আমি অটোরিকশা চালককে তাদের যাওয়ার ভাড়া দিয়ে দিই।
বিজ্ঞাপন
রবিউল বলেন, আমাকে যখন অস্ত্র ঠেকিয়ে সব নিয়ে যাচ্ছিল তখন দেখলাম সামনে আরও দুটি অটোরিকশায় চালক বসে আছেন এবং তারা দৃশ্যটি বসে বসে দেখছেন। মনে হচ্ছে তারাও এই দলের সদস্য। তারা রিকশা চালকের আড়ালে ছিনতাই কাজের সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণা করছি।
তিনি কোনো আইনি ব্যবস্থা কেন নেননি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আমি এই এলাকা দিয়ে নিয়মিত চলাচল করি। এজন্য আমি ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ নিলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে। কারণ, তাদের আটকের কয়েক দিনের মধ্যে তারা জামিনে চলে আসে। এজন্য আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছি না।
বিজ্ঞাপন
ওই ঘটনার একটি সিসিটিভি ফুটেজ ঢাকা মেইলের হাতে এসেছে। যেখানে দেখা যায়, ওইদিন বিকেল ৫টা ৫৩ মিনিটে বসিলা ৪০ ফিট ও চন্দ্রিম মডেল টাউন এলাকার মাঝে খালের ওপর বসিলা অংশে বাঁশের সাঁকোর সামনে গিয়ে একটি অটোরিকশা একজন যাত্রী নিয়ে দাঁড়ায়। ওই সময় ওইখানে আরও দুটি রিকশা আড়াআড়িভাবে সড়কের ওপর আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিল। রিকশা চালক থেমে কিছুক্ষণ কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় এক মিনিটের মধ্যে দেশীয় ধারালো অস্ত্র হাতে মুখে মাস্ক পরা দুজন এসে রিকশায় থাকা যাত্রীর সামনে দাঁড়ায়। ওই সময় যাত্রীকে ছিনতাইকারীদের হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে কোপ দেওয়ার চেষ্টা করে সব ছিনিয়ে নেয়। তিন মিনিটের এই ছিনতাই মিশনটি শেষ করে ৫টা ৫৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডে ছিনতাইকারীরা যাত্রী নিয়ে আসা সেই অটোরিকশাটিতেই চলে যায়। ছিনতাইকারীরা যাওয়ার আগে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সেই যাত্রীর কাছ থেকে অটোরিকশার ভাড়া নিতে দেখা যায়।
দিনের আলোতেও নিরাপদ নয় অটোরিকশা যাত্রীরা
এমন ঘটনা এখন বসিলার সব হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, নবীনগর, ঢাকা উদ্যান, নবোদয়, চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, শেখেরটেক, মনসুরাবাদ, সুনিবিড় হাউজিংসহ পুরো মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় অহরহই ঘটছে। শুধু মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকা নয়, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, গাবতলী, মিরপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় এখন অটোরিকশায় করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হু হু করে বাড়ছে অটোরিকশার সঙ্গে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছিনতাইয়ের ঘটনাও। এক সময় রাতের আঁধারে সীমিত এলাকায় এই অপরাধ হলেও এখন দিনের আলোতেও কেউ নিরাপদ নন। অটোরিকশা চালকদের একটি বড় অংশের ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যোগসাজস আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক সময় অটোরিকশা চালকরাও ভিকটিম হচ্ছেন। নির্জন বা কম ভিড়যুক্ত জায়গায় পৌঁছালে তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মোবাইল, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে চালককেও মারধর বা অচেতন করে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা এক অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান শুরু হয়। অভিযোগে বলা হয়, রাজশাহী থেকে ঢাকার টেকনিক্যাল বাসস্ট্যান্ডে আসা এক যাত্রী অটোরিকশাতে ওঠেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবনের সামনে পৌঁছালে চালক গাড়ি বন্ধ করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। এসময় পূর্ব থেকে ওঁৎপেতে থাকা তিনজন সহযোগীর সহায়তায় যাত্রীর গলায় ছুরি ধরে নগদ টাকা, দুটি মোবাইল ফোন ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে অতিরিক্ত টাকার জন্য যাত্রীকে মারধর ও চাপ প্রয়োগ করে পরিবারের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে আরও টাকা আদায় করে ছিনতাইকারীরা। শেষে আগারগাঁও এলাকায় নির্জন স্থানে তাকে নামিয়ে পালিয়ে যায় চক্রটি। এ ঘটনায় ডিবি তেজগাঁও বিভাগ অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে, মিরপুর থেকে কাজ শেষে ফিরছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী কামরুল হাসান। পথে দুজন যাত্রী সেজে তার পাশে বসে। কিছুদূর যাওয়ার পরই তারা চাকু ঠেকিয়ে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। তিনি বলেন, ‘এত দ্রুত সবকিছু ঘটে গেল যে, কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। চিৎকার করতে গেলেও ভয় লাগছিল।’
কী বলছে পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অটোরিকশায় করে ঘুরে ঘুরে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি নতুন হওয়ায় কাউকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তবে এমন ঘটনা এখন প্রায়ই ঘটছে। আমরা এ চক্রকে চিহ্নিত করতে মাঠে কাজ করছি। আমাদের পাশাপাশি কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে। আমরা আশা করছি, শিগগির এ চক্রটিকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সমাজে এখন যে কেউ চাইলে অপরাধ করতে পারে। তবে, অটোরিকশায় করে ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত ঘটছে। মূলত অটোরিকশা চালকরা বেশি লাভের আশায় ছিনতাইকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে এমন কর্মকাণ্ডের সাথে লিপ্ত হচ্ছে। এছাড়া শহরজুড়ে হাজার হাজার অটোরিকশা যুক্ত হওয়ায় কে ভালো কে মন্দ তা কোনোভাবেই নির্ধারণ করা যায় না। সেজন্য অপরাধীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। অটোরিকশা চালকদের অন্তত একটা নীতিমালার মধ্যে নিয়ে এলে এ ক্ষেত্রে অনেক অপরাধীকে যেমন চিহ্নিত করা যাবে, তেমনি অপরাধীর সংখ্যা কমে যাবে।’
একেএস/জেবি

