বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

পল্লবীতে ভোল পাল্টে ফের সক্রিয় অপরাধী চক্র

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০৯ পিএম

শেয়ার করুন:

পল্লবীতে ভোল পাল্টে ফের সক্রিয় অপরাধী চক্র
পল্লবী এলাকায় অপরাধ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকার যে কয়টি ক্রাইম জোন রয়েছে এর মধ্যে মিরপুরের পল্লবী অন্যতম। এই পল্লবীতে প্রতি মাসে নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটতেই থাকে। খুন, সন্ত্রাসী দুই গ্রুপের মারামারি বা গোলাগুলির ঘটনা অহরহই ঘটে এখানে। টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এখানকার অপরাধীরা সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থেকেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ ভোল পাল্টে পল্লবী এলাকায় সক্রিয় হতে শুরু করে। এলাকার আধিপত্য ধরে রাখতে তারা পরস্পরের সঙ্গে মারামারিতেও লিপ্ত হয়।

পুলিশ বলছে, তারা অপরাধী চক্রগুলোকে নজরে রেখেছে। তারপরও মাঝে-মধ্যে ঘটছে বড় বড় ঘটনা। ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। অপরাধীরা যেন নতুন করে মাথাচাড়া দিতে না পারে সেই চেষ্টা করছে তারা।


বিজ্ঞাপন


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত সময়ে এই পল্লবীতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। সে চিত্র এখনো বদলায়নি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের নতুন নতুন মুখ আবারও আসতে শুরু করেছে। পুরনোদের হটিয়ে এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ। গত নয় মাসে পল্লবীতে ২০টির বেশি ঘটনা ঘটেছে। তবে সব ঘটনা মিডিয়ায় আসেনি। অনেক ঘটনাই চাপা পড়ে গেছে।

পল্লবীবাসী জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর পল্লবীতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যারা আগে ছিল তারা এখন আবারও মাঠে নতুন পরিচয়ে আসছে। নতুন লোকজন সংগ্রহ করে ভূমি দখল, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ে নেমেছে তারা। তারা বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার ও আটকও হচ্ছেন। তবে বেশির ভাগই জামিনে বেরিয়ে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে।

গোলাগুলি ও কোপাকুপি যেন ডালভাত!


বিজ্ঞাপন


পল্লবীর একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছে, আগেও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সক্রিয় ছিল। আবারও তারা সক্রিয় হচ্ছে। বাউনিয়াবাঁধ, ১১ ও ১০ নম্বর সেকশন বেশি অপরাধপ্রবণ। বিশেষ করে যেসব জায়গায় বিহারিরা থাকে সেই এলাকাগুলোতেই অপরাধী বেশি। এসব এলাকায় গোলাগুলি ও কোপাকুপি যেন ডালভাত।  

গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর পল্লবী এলাকার মোড়াপাড়ার ই ব্লকে পেপার সানি নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে প্রতিপক্ষের লোকজন।

এলাকাবাসী জানায়, পেপার সানিকে রাব্বী গ্রুপের লোকজন কুপিয়ে আহত করে। পরে তারা গুলি ও ককটেল ফুটিয়ে চলে যায়। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। তারই জের ধরে পেপার সানিকে একা পেয়ে কুপিয়ে আহত করে রাব্বি গ্রুপের লোকজন। এরপর সানির লোকজন তাকে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতাল নেয়। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় একটি মামলা হয়েছে এবং তিনজনকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরের দিকে পল্লবী এলাকায় ভাই বোনকে গুলির করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন (৪৪) ও মোছা. শাহিনুর বেগম নামে দুজন আহত হন। আহত দুজন সম্পর্কে ভাই-বোন।

আহতদের ভগ্নিপতি আমির হোসেন জানিয়েছিলেন, তার শ্যালক জসিম টিভি শো-রুমের ব্যবসায়ী। ভোরের দিকে শবে বরাতের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি।

তার অভিযোগ, এ সময় বাসার সামনে পূর্ব শত্রুতার জেরে একই এলাকার শরিফ, তুহিন, শহিদুল, সুজন, রিয়াজের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয় জসিমের। একপর্যায়ে শহিদুল জসিম উদ্দীনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে জসিম উদ্দিনের ডান এবং বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে দুটি গুলি বিদ্ধ হয়।

তবে আহত ভাই বোনের দাবি, পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষের গুলিতে তারা আহত হন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ ঘটনায় তাদের মাদক ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল৷

আরও পড়ুন

‘সন্ত্রাসের জনপদ’ পল্লবী: আধিপত্য ধরে রাখতে সক্রিয় বিভিন্ন গ্রুপ

পল্লবীতে গুলির নেপথ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব

গত ২২ মার্চ পল্লবী এলাকায় সেলিম (৩৫) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরিবারের দাবি ছিল-স্থানীয় মাদক কারবারিরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

নিহত সেলিমের খালা ইয়াসমিন আক্তার জানিয়েছিলেন, মিরপুর-১১ এলাকায় সন্ধ্যার দিকে ওয়াপদা বিল্ডিংয়ের পাশে মাঠে পূর্বশত্রুতার জেরে সেলিমকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রাখে।

তিনি আরও জানান, সেলিম সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলেন। এ ঘটনায় ওই সময় পারভেজ নামের এক যুবকসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। তারাই তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে ফেলে রেখে যায়। পরে এলাকাবাসী তাদের খবর দিলে তারা হাসপাতালে ছুটে যান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি প্রতিপক্ষের হামলায় আহন হন সন্ত্রাসী পেপার সানি। তার লোকজন সম্প্রতি মিল্লাত ক্যাম্পে মাদক কারবারি জামিলার কাছে চাঁদা না পেয়ে তার বাসার সামনে গোলাগুলি করে চলে আসে। পেপার সানি মূলত একজন মাদক কারবারি৷ তার নামে থানায় ১০-১৫টি মাদক মামলা রয়েছে৷

PPP
ঢাকার অপরাধ জোনের একটি পল্লবী। ছবি: সংগৃহীত

পেপার সানি ছাড়াও এলাকার আধিপত্য ধরে রাখা এবং মাদক কারবারের দ্বন্দ্বে বারবার জড়াচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপে।পেপার সানির বাইরে কিশোর গ্যাং আশিক ও ডাশা শরীফ। এই দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম গ্রুপের লোক পাগলা মামুনের ডান ও বাম হাত। আর মামুন হচ্ছেন সাবেক কমিশনার জহিরের আপন ভাই। এই জহির আওয়ামী লীগের সময়ে পল্লবী এলাকার কাউন্সিলর ছিলেন।

ভোল পাল্টে কিশোর গ্যাং লিডার এখন বিএনপি! 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগেও সক্রিয় ছিলেন কিশোর গ্যাং লিডার আশিক। তিনি আগে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু এখন করেন বিএনপি। আগে প্রতিদিন কোপাকুপি গোলাগুলি করে পল্লবীকে অশান্ত করার নেপথ্যের কারিগর ছিলেন আশিক। গত ৩ আগস্ট তাকে অজ্ঞাত মামলায় চালান দেয় র‌্যাব। জেল থেকে গত ৭ আগস্ট ছাড়া পেয়ে সেই আশিক বিএনপির কর্মী পরিচয় দেন। অথচ তার বাবা খালেক বাউনিয়াবাঁধ ৫৪ নম্বর প্লটের ইউনিটের আওয়ামী লীগের সভাপতি। আশিক পাগলা মামুনের লোক। তিনি মূলত ভাড়াটে কিলার। কিলারদের দলনেতা।

আশিকের মূল পেশা ছিনতাই। তার এ কাজে সহায়তার জন্য রয়েছে বিশাল টিম। সেই টিমের কাজই হচ্ছে নামীদামি ফোন ছিনতাই করে তার কাছে পৌঁছানো। এরপর সেগুলো বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করেন আশিক ও তার লোকজন।  

আশিকের বাইরে রয়েছে আরেক গ্রুপ ডাশা শরীফ। কানকাটা গ্রুপের অন্যতম নেতা ডাশা শরীফ। ডাশারও রয়েছে একটি গ্রুপ। আগে কানকাটা গ্রুপের প্রধান ছিলেন অনিক। এখন ডাশা শরীফ সেই গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নেতৃত্ব দেন। তার দুই থেকে আড়াইশ লোক রয়েছে। বিভিন্ন ভূমিদস্যুতায় সহায়তা করে এই ডাশা গ্রুপ৷

গত কয়েক বছর ধরে পল্লবীর বিভিন্ন এলাকায় যত গুলির ঘটনা ঘটেছে সবখানে আশিক ও ডাশা গ্রুপের লোকজন জড়িত ছিল বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে।

আরও পড়ুন

রাতের পূর্বাচল ‘ভয়ঙ্কর’: অপরাধ রোধে বসছে সিসি ক্যামেরা, ডিবির নজরদারি

মাদক অধিদফতরে বহাল ‘আওয়ামী চক্র’, পদোন্নতি পেতে মরিয়া

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিমের ডান হাত খ্যাত পাগলা মামুন। জহির কমিশনারের আপন ভাই৷ জহির আওয়ামী লীগের সময়ে কমিশনার ছিলেন ভাসানটেক এলাকার। মামুন ভাসানটেক বস্তি ও সাভারে থাকেন।

আরও জানা গেছে, পাগলা মামুনের ডানহাত ডাশা শরীফ আর বামহাত আশিক। যত ছিনতাই হয় তার অর্ধেক ভাগ পান আশিক। এছাড়াও পান মামুন। ইব্রাহীম গ্রুপের এই ডাশা শরীফ ও আশিক যৌথ বাহিনীর কারণে এলাকা ছাড়া। তারা কিছুতেই এলাকায় ঢুকতে পারছেন না। তবে সরাসরি কল করা যায় এমন মোবাইল ব্যবহার করেন না তারা। তবে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেন তাদের বিভিন্ন সদস্যের সাথে। 

জানা গেছে, ডাশা শরীফ আগে সোহেলের নেতৃত্বে বাউনিয়াবাঁধ, ই-ব্লকে সোহেল গ্রুপে কাজ করতেন। এই গ্রুপে রিয়াজ, জুয়েল ও সজীবসহ ১২-১৫ জন সদস্য। তারা পুলিশের তালিকাভুক্ত। এই গ্রুপের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আগে ৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈম ছিলেন। কিন্তু এই নাঈম এখন পলাতক। তার স্থলে বসেছেন ডাশা শরীফ।

অন্যদিকে পল্লবীর তালতলা মোড়, নাভানা আবাসিক ভবন ও সবুজ বাংলা আবাসিক গেট এলাকায় আশিক গ্রুপের উৎপাত আগেও ছিল এখনো রয়েছে। আশিকের নেতৃত্বে এ গ্রুপে শামীম, রায়হান, আল-আমিন, রাব্বি, রনি, মহিন ও সুমনসহ ১২-১৩ জন সদস্য সক্রিয় রয়েছেন। আশিক গ্রুপকে আগে লিড দিতেন পল্লবী থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিলন ঢালী। এই মিলন ঢালিও ৫ আাগস্টের পর পলাতক।

পল্লবী জোনের এডিসি শাহিদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত এসব অপরাধীকে ধরছি। তাদের তালিকা করে নজরদারি রাখছি। তবে সম্প্রতি ঘটনাগুলোকে আমরা গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। অপরাধী চক্রকে নজরে রেখে তারা যাতে কোনো অপরাধ না করতে পারে সে বিষয়টি আমরা দেখছি।’

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর