ইট-পাথরের এই শহরে চার দেয়ালে আটকা থাকে হাজারো মানুষের জীবনের গল্প। অধিকাংশ মানুষের সেই গল্পগুলো শোনার কেউ নেই। তেমনি একজন নারী রেহানা বেগম।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৩০ বছর সরকারি দপ্তরের একটি ক্যান্টিনে কাজ করা রেহানা চাকরি হারিয়ে এখন ফুটপাতে নেমে এসেছেন। কী হবে ভবিষ্যতে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ৫২ বছর বয়সী এই নারী।
বিজ্ঞাপন
২০ বছর বয়সে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি এলাকা থেকে রেহানা বেগম এক বুক স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ঢাকায় এখন ভাড়া থাকেন। কোনোমতে স্বাক্ষর করতে পারা অশিক্ষিত এই নারী ভেবেছিলেন, বড় লোকদের নিত্যদিনের কাজ-কর্ম করে দিয়েই স্বচ্ছলভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু সেই বড় সাহেবদের কেউ কেউ ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ হলেও তার পেছনে ফিরেও তাকায়নি কেউ!
রেহানা বেগম ঢাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর পরিচালিত ৫০ সিটের একটি আবাসিক ক্যান্টিনে ৩০ বছর কাজ করেছেন। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সেই ক্যান্টিনে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প বসানোর ফলে বর্তমানে দপ্তরটির ক্যান্টিন কার্যক্রম বন্ধ আছে। ক্যান্টিনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের অন্য কাজে সংযুক্ত করা হলেও দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ৩০ বছর ধরে কাজ করা রেহানা কোনো কাজ পাননি। উপায় না পেয়ে বাঁচার তাগিদে দপ্তরটির প্রধান ফটকের পাশে এক কোণে সবজি নিয়ে বসেছেন তিনি।
তবে সেখানেও ভালো নেই রেহানা। প্রতিদিন গার্ড এসে উঠে যেতে বলে। এমন যন্ত্রণা সহ্য করেই টিকে আছেন জীবিকার তাগিদেই।
রেহানা বেগম বলেন, ‘৩০ বছর ধরে অফিসের ভেতরেই আছি। তরকারি কাটা, পেলেট মুছার কাজ করতাম। জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আন্দোলনের সময় আর্মিরা এসেছে। এখন কাজ হারিয়েছি। কয়েকমাস বসেছিলাম। গরিব মানুষ বসে থাকলে তো পেটে ভাত জুটবে না। তাই এখন কারওয়ান বাজার থেকে সবজি কিনে এনে কিছু লাভে এখানে বেচি।’
বিজ্ঞাপন
রেহানা জানান, তার ছেলে-মেয়ে পাঁচজন। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। রেহানা এখন ছোট ছেলের সঙ্গে থাকেন। তার স্বামী ভবঘুরে। ছেলের মাসে ৯ হাজার টাকা চাকরির বেতন আর তার সবজি বিক্রি করা অর্থেই চলছে সংসার।
কাজ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে তেমন একটা ক্ষোভ নেই রেহানার। তবে অভিমান ৩০ বছর যেখানে সময় দিলেন, সেখানে সবার জায়গা হলেও কোনো এক কোণে তার জায়গা না থাকা নিয়ে!
রেহানা বলেন, ‘এগুলো কাকে বলব। আর বলেই কি হবে। সরকারি চাকরি করার মতো টাকা তো আমার ছিল না। না হলে কবেই সরকারি হয়ে যেত। আমি তো কাজ করি দৈনিক মজুরিতে। এই চাকরির তো কোনো ঠিক নাই।’
‘আমাকে মাসে ৯ হাজার করে টাকা দিতো। যে সময় চাকরিটা গেল, সে মাসে আমাকে ২ হাজার টাকা দিয়েছে। পরে কয়েকবার বলে বলে আরও ৩ হাজার টাকা দিয়েছে। এখনো ৪ হাজার টাকা দেয়নি। বলে, আপনি কাজ খুঁজে নেন গা। কিন্তু বললেই কি কাজ পাওয়া যায়। তাই তিন হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে এখন সবজি বিক্রি করছি। প্রতিদিন দু’তিন শো টাকা লাভ হয়। কিন্তু খারাপ লাগে, প্রতিদিন গার্ডরা এমন আচরণ করে! বয়স হয়েছে। অন্য কাজও তো করতে পারব না।’-বলেন রেহানা।
এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ওই ক্যাম্পে যোগাযোগ করলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানান, ‘সেনাবাহিনী নিয়মের বাইরে যেতে পারে না। ওই নারীকে এখানে কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে যে দপ্তরে ওই নারী ছিলেন, সে দপ্তরে জানানো হবে, যেন মানবিকভাবে বিষয়টি দেখা হয়।’
ঢাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. শাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ‘রেহানার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ খবর নেব।’
এমএ/এমআর