রাজধানী ঢাকার ফুসফুস হিসেবে পরিচিতি রমনা পার্ক। দূষিত ঢাকার বুকে বিশুদ্ধ বাতাস আর প্রশান্তির জায়গা হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে পার্কটির। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখানকার পরিবেশ কতটা দূষণমুক্ত। হর্নের শব্দ এখানে আসা দর্শনার্থীদের জন্য কতটা প্রশান্তির? এটি সহজেই টের পান এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা। হর্নের অযাচিত ব্যবহার যে শুধু মানুষকেই চেতিয়ে তুলছে এমনটি নয়; রাজধানীর প্রাণ-প্রকৃতিকেও বিষিয়ে তুলছে।
সম্প্রতি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও এর কাছের তিন কিলোমিটার মহাসড়ককে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে গত বছরের ১ অক্টোবর এ ঘোষণা আসে। নীরব এলাকা ঘোষণা হলেও এর বাস্তবায়ন নেই সেই এলাকায়। শুধু এটিই নয়; ২০১৯ সালে সচিবালয় এলাকা, শিশুমেলা, গণভবন, বিজয় সরণি, স্পারসো, রোকেয়া সরণি, পরিসংখ্যান ভবনের সামনে, শহীদ শাহাবুদ্দিন সড়ক ও বীরউত্তম খালেদ মোশাররফ অ্যাভিনিউকেও ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু এসব এলাকার বাসিন্দাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তিক্ত। তারা বলছেন, শুধু নীরব এলাকা ঘোষণা করে দিলেই হবে না। তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সরকারকে কাজ করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোতি আক্তার বলেন, আমি জানি সচিবালয় এলাকা মানেই নীরব এলাকা। কিন্তু নীবর এলাকায় সব সময় হর্নের দৌরাত্ম্যই দেখে আসছি। আমি এখন কথা বলছি, তাও হর্ন। এপাশ থেকেও আসছে, ওই পাশ থেকেও আসছে। সুতরাং শুধু ঘোষিত হলেই হবে না। তার বাস্তবায়নে সরকারকে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকি। এখানে সারাদিন তো শব্দদূষণের দৌরাত্ম্য থাকেই। রাতেও শান্তিতে ঘুমানো যায় না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় হর্নের শব্দে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি।
বিজ্ঞাপন
হর্ন, ইঞ্জিন ও চাকার কম্পন, নির্মাণকাজ বা ইট ও পাথর ভাঙার শব্দ, কলকারখানা, জেনারেটর, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উচ্চ শব্দের মাইকিং এসব মাধ্যমের শব্দদূষণ সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় দিনের সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতের ৪৫ ডেসিবেল সহনীয়। আর বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের ৭০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় দিনের ৭৫ ডেসিবেল নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় শব্দের আদর্শ মান দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল। কিন্তু এসব মাত্রা-জ্ঞান কাগজে থাকলেও বাস্তবায়নে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। এতে শারীরিক ও মানসিক নানা জটিলতার মুখে পড়ছেন রাজধানীবাসী। অযাচিত হর্নের তোপের কাছে যেন অসহায় তারা। শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন মারাত্মক ঝুঁকিতে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, শব্দদূষণ খালি চোখে দেখা যায় না। একারণে ক্ষতির মাত্রাটা সরাসরি মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। শব্দদূষণ এক ধরনের নীরব ঘাতক। এটি তিলে তিলে মানুষকে করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত করে।
শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়। বধিরতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, ঘুম কম হওয়া, হৃদরোগসহ শিশুর মানসিক বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করে। স্বল্পমেয়াদী শব্দদূষণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদী শব্দদূষণ শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দিতে পারে। আর শ্রবণশক্তি কমে গেলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা, রাগ, ক্লান্তি, ক্ষোভ, স্মৃতিশক্তি হ্রাসসহ মানুষের সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউটের অডিওলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জুনায়েদ রহিম ঢাকা মেইলকে বলেন, শব্দদূষণের ফলে শারীরিক ও মানসিক নানা জটিলতা তৈরি হয়। শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে। রাজধানীতে শব্দদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। শব্দদূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আরও পড়ুন
শব্দদূষণকে অনেকেই ‘শব্দ–সন্ত্রাস’ বলে থাকেন। এই সন্ত্রাসের তোপের মুখে দিশেহারা রাজধানীর প্রাণিকুল। তীব্র শব্দের কারণে পাখিরা পড়েছে নানা সংকটে। নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোতে পাখিদের কিছুটা বিচরণ দেখা গেলেও সড়কের পাশে পাখিদের কোনো বিচরণ নেই। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে পথের ধারের গাছে ‘ঠু’ মারলেও শব্দের দৌরাত্ম্যে পালাতে হয় তাদের।
পরিবেশবিদরা বলছেন, মানুষ একটু সচেতন হলেই প্রাণিকুলে স্বস্তি ফিরে আসবে। প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষের সুন্দর বসবাসস্থল হয়ে উঠবে রাজধানী ঢাকা। সেই স্বপ্নের কথাই বলছেন পরিবেশবিদরা।
পরিবেশবাদী যুব সংগঠন গ্রিন ভয়েসের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হুমায়ুন কবীর সুমন ঢাকা মেইলকে বলেন, শব্দদূষণের ফলে মানুষের পাশাপাশি পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীদের প্রতিও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সুতরাং যারা বিনা প্রয়োজনে হর্ন বাজান, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। পাশাপাশি আইনের প্রয়োগটাও দরকার। কারণ দেশে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগটা নিশ্চিত হচ্ছে না।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে জানান, দুটি প্রক্রিয়ায় শব্দদূষণ কমাতে সহায়ক। এরমধ্যে একটি হলো সচেতনতা বাড়ানো এবং অন্যটি আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি।
এমআই/জেবি