বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

ঢাকায় কানে কম শোনেন ৫৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২ মার্চ ২০২৩, ১১:০৭ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

শব্দ দূষণের কারণে রাজধানী ঢাকায় ৫৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ কানে কম শোনেন । ৩ মার্চ বিশ্ব শ্রবণ দিবস উপলক্ষে এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে স্পিচ এ্যান্ড হিয়ারিং এসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থা। 
 
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ট্রাফিক পুলিশে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ যারা সারাদিন প্রায় অধিক শব্দের মধ্যে রাস্তায় কর্মরত, তারা শব্দ দূষণের প্রভাবে অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি তাদের শ্রবণের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তাদের শ্রবণ ক্ষমতাও কমতে থাকে। একপর্যায়ে ব্যক্তি একেবারে বধিরও হয়ে যেতে পারেন। 
 
শুধু তাই নয়, শব্দ দূষণে প্রতি বছর প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। থাইরয়েড রোগী বাড়ছে। যাদের অধিকাংশ ৪০ বছরের নারী। এছাড়াও বন্ধ্যত্ব বাড়ছে, যার মূলে পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ।
 
প্রতিবেদনটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৯৯ সালের গাইডলাইন) মানদণ্ড অনুসারে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। সে হিসেবেও রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচারে পিষ্ট।
 
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছর ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দের তথ্য উপাত্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে। সংস্থাটির জরিপ বলছে, ১০টি স্থানের নীরব এলাকায় ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৫০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, আবাসিক এলাকায় ৯১ দশমিক ২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে মিশ্র এলাকায় ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৬০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬১ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৭০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় ১৮ দশমিক ২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৭৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে। সমগ্র ঢাকা শহরের ১০টি স্থানেই ৮২ শতাংশ সময় ৬০ ডেসিবলের উপরে শব্দ পাওয়া গিয়েছে।

২০২৩ সালের বিশ্ব শ্রবণ দিবসের প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে স্পীচ অ্যান্ড হিয়ারিং এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মীর মোশারোফ হোসেন জানান, বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ অনুসারে দেখা যায় উচ্চ শব্দ জনসাধারণের মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার অন্যতম কারণ। এটি উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ হৃদস্পন্দন, মাথ্যাব্যথা, বদহজম ও পেপটিক আলসার সৃষ্টির কারণ, এমনকি গভীর ঘুমকেও ব্যাহত করছে। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো স্থানে আধঘণ্টা বা তার অধিক সময় ধরে ঘটা ১০০ ডিবি বা তার অধিক শব্দ দূষণের ফলে বধির হয়ে যেতে পারে।
 
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য, যেখানে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়। ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস' শীর্ষক এই প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা এই প্রতিবেদনে আসা শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
 
কখন শব্দ দূষণ ঘটে:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতানুসারে, সাধারণত ৬০ ডিবি শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে ফেলতে পারে এবং ১০০ ডিবি শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে হিসাব করে দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরের যেকোনো ব্যস্ত সড়কে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা ৬০ থেকে ৮০ ডিবি, যানবাহনের শব্দ মিলে তা ৯৫ ডিবিতে দাঁড়ায়, লাউড স্পিকারের সৃষ্ট শব্দ ৯০ থেকে ১০০ ডিবি, কল কারখানায় ৮০ থেকে ৯০ ডিবি, রেস্তোরাঁ এবং সিনেমা হলে ৭৫ থেকে ৯০ ডিবি, মেলা-উৎসবে ৮৫ থেকে ৯০ ডিবি, স্কুটার বা মটরসাইকেলের ৮৭ থেকে ৯২ ডিবি এবং ট্রাক-বাসের সৃষ্ট শব্দ ৯২ থেকে ৯৪ ডিবি। কিন্তু শব্দের বাঞ্ছনীয় মাত্রা হলো; শয়নকক্ষে ২৫ ডিবি, বসবার ও খাবার ঘরে ৪০ ডিবি, কার্যালয়ে ৩৫-৪০ ডিবি, শ্রেণীকক্ষে ৩০-৪০ ডিবি, গ্রন্থাগারে ৩৫-৪০ ডিবি, হাসপাতালে ২০-৩৫ ডিবি, রেস্তোরায় ৪০-৬০ ডিবি এবং রাত্রিকালে শহর এলাকায় ৪৫ ডিবি। যখন শব্দ এই সীমা অতিক্রম করে তখনই শব্দ দূষণ ঘটে।
 
শব্দ দূষণে কি ক্ষতি হচ্ছে:
ঢাকা শহরের শব্দ দূষণ প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার শিশুর শ্রবণ ক্ষমতাকে ধ্বংস করছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি তিন বছরের কম বয়স্ক শিশু কাছাকাছি দূরত্ব থেকে ১০০ ডিবি মাত্রার শব্দ শোনে, তাহলে সে তার শ্রবণ ক্ষমতা হারাতে পারে। শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য উপাদানগুলো হলো মোবাইল, হেডফোন, ও টেলিভিশনের উচ্চ শব্দ; কলকারখানার শব্দ এবং উচ্চ মাত্রার চিৎকার, হৈচৈ, গোলমাল। শব্দ স্পন্দনের একক হলো হার্টজ। মানুষ সাধারণত ১৫ থেকে ২০ কিলোহার্টজ (কেএইচজেড) স্পন্দনের শব্দ শোনে।
 
প্রতিবেদনে শব্দ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশমালাও ওই প্রতিবেদনে দিয়েছে স্পিচ এ্যান্ড হিয়ারিং এসোসিয়েশন।


বিজ্ঞাপন


সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে; 
হাড্রলিক হর্ন বন্ধ করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৯৯ সালের গাইডলাইন) মানদণ্ড অনুসারে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল বাস্তবায়ন করা। উচ্চ শব্দে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ইয়ার প্লাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। আর পেশাগত কারণে উচ্চ শব্দে থাকতে হলেও তা যেন দৈনিক ছয় থেকে সাত ঘণ্টার বেশি না হয়। সকল পাঠ্যসূচীতে শব্দ দূষণ রোধের সচেতনতা আওতাভুক্ত করা।

পাবলিক প্লেসে মাইক কিংবা স্পিকার ব্যবহারে শব্দের মাত্রা ৫৩ ডেসিমেলের মধ্যে রাখার জন্য আইন প্রণয়ন করা। শব্দ দূষণ রোধে ট্রাফিক পুলিশকে ক্ষমতা দিতে হবে।

আবাশিক এলাকাকে নিরব এলাকা ঘোষণা করে তা বাস্তাবায়নে পুলিশকে ক্ষমতা দিতে হবে। এছাড়াও আবাসিক এলাকায় কনস্ট্রাকশান কাজের শব্দ দূষণ বন্ধ করে আইন পাশ করতে হবে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, উপাশনালয়ের আশেপাশে শব্দ দূষণ রোধ বাস্তবায়ন করা।
 
শিল্প কারখানায় তীব্র শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতির প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটিয়ে শব্দ দূষণ উৎসস্থলেই নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন করা। বিভিন্ন উৎসবে আতশবাজীর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করে, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তিকে অবস্থানকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে শব্দ সচেতনামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

সরকারিভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে শব্দ দূষণের কারণ ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে গণবিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রত্যেক মানুষের শ্রবণ শক্তি পরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
 
কেআর/এমএইচএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর