শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম যেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম যেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন ও সহিংসতা চলছে বলে গুজব ছড়াচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। অথচ দেশের বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। শেখ হাসিনার পলায়নের পর বরং সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সুরক্ষার বিষয়টি। তাদের ধর্মীয় উপসনালয় ও বাড়িঘর যেন দুর্বৃত্তদের লক্ষ্যবস্তু না হয় সেজন্য আন্দোলনকারী ছাত্রদের পাশাপাশি ইসলামি সংগঠনগুলোও বেশ সক্রিয় ছিল। কারণ, এ বিষয়ে আগে থেকেই সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছেন দেশের সেলিব্রেটিরা।

কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে প্রোপাগণ্ডা যেন শেষই হচ্ছে না। তাদের এমন গুজবের ফ্যাক্ট চেক করছে আল জাজিরা, ডয়েচে ভেলে, দ্য কুইন্ট, দ্য নিউ মিনিট, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম। তারা বলছে, পুরোনো বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে ছড়ানো হচ্ছে এসব গুজব। এমনকি, হিন্দু মহাজোটের নেতা গোবিন্দ প্রামাণিকও বুধবার (৭ আগস্ট) রাতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। গুজব না ছড়াতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: মন্দির নিরাপত্তায় জামায়াত নেতারা

জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) জানায়, বাংলাদেশে ধর্ষণ ও সহিংসতার গুজব ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে পুরানো ছবি। ‘ফ্যাক্ট চেক-ফলস ক্লেইম ফুয়েল এথনিক ক্লিনসিং ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক রিপোর্টে তারা দেখিয়েছে, ভারতীয় অনেক গণমাধ্যম এবং ফেসবুক, টুইটার, এক্স প্ল্যাটফর্ম, ইউটিউব ও টিকটকে পুরোনো ছবি ও ভিডিও দিয়ে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

আবার কিছু ছবিকে তারা প্রচার করেছেন ভুলভাবে। ডয়চে ভেলে উদারহরণ হিসেবে দেখায়, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার বাড়িতে আগুনের ছবি তারা হিন্দু বাড়িঘরে হামলার ছবি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। এ সম্পর্কে ৯ আগস্ট দুপুরে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক বার্তায় গুজবে কান না দিতে অনুরোধ করেছেন লিটন দাস। তিনি ওই বার্তায় বলেন, ‘সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন মিডিয়াতে একটি খবর প্রচার হয়েছে আমাদের বাড়িতে হামলার ঘটনা নিয়ে, যার কোন সত্যতা নেই। কেউ এইসব গুজবে কান দিবেন না। আমি এবং আমার পরিবার এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাপদে রয়েছি। আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ।’

আরও পড়ুন: সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান ছাত্রদলের


বিজ্ঞাপন


মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টও বাংলাদেশে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। তাদের খবরে বলা হয়, শিক্ষার্থী-জনতা সহিংসতা প্রতিরোধে পাহারা বসিয়েছেন। একইসঙ্গে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোও নেতাকর্মীদের কঠিন বার্তা দিয়েছে।

ভারতের টাইমস গ্রুপের মালিকানাধীন ‘মিরর নাউ’-এর ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও প্রতিবেদন করে ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা?’ নামে। মিরর নাউয়ের ভিডিওটিতে চারটি বাড়িতে সহিংসতা এবং অগ্নিসংযোগের ফুটেজ দেখা যায়। অথচ, অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ওই চারটি বাড়ির মধ্যে দুটি বাড়ি ছিল মুসলিম মালিকানাধীন। শুধু তা–ই নয়, একটি বাড়ি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি জাদুঘর। ভিডিওটিতে কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই আরও দাবি করা হয়, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে ২৪ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। 

আরও পড়ুন: সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাসহ সামাজিক কাজে শিক্ষার্থীরা

দাবিগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করতে গিয়ে আল জাজিরা জানতে পেরেছে, গত সোমবার হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুজন হিন্দু হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে তাঁরা সংখ্যালঘু হিসেবে হামলার শিকার হননি। নিহত ওই দুজনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং অন্যজন আওয়ামী লীগের কর্মী। আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার নিপীড়ন চালানোর জন্য পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা গণরোষের মুখে পড়েছিলেন। 

এদিকে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির প্রধান শুভেন্দু অধিকারীর উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এক কোটির বেশি শরণার্থী রাজ্যটিতে অনুপ্রবেশ করতে পারে। তবে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি এখনো কোথাও দেখা যায়নি বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। 

আরও পড়ুন: ‘হিন্দু ভাইদের অনিরাপদ রেখে আমরা ঘুমাতে পারি না’

মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ সংবাদ সংস্থা হিসেবে পরিচিত এএনআইয়ের এক প্রতিবেদনে দেশটির একজন ছাত্রনেতাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানটি বাংলাদেশের শত্রুদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। 

টাইমস অব ইন্ডিয়ার আরেকটি উদ্ভট নিবন্ধে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল জামায়াতে ইসলামী শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। গণমাধ্যমটির এ খবরও বিভ্রান্তিকর। কেননা এবারের আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, যেহেতু তারা ১৫ বছর ধরে হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনে ক্ষুব্ধ ছিলেন। 

আরও পড়ুন: মন্দির পাহারা দিচ্ছেন ভালো, মানুষকে আতংকিত করবেন না: প্রিন্স মাহমুদ 

এবিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ভারতীয় গণমাধ্যম ‘ইসলাম আতঙ্ক’ ছড়াতে এসব প্রতিবেদন করেছে। আল জাজিরাকে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল তাতে সর্বস্তরের জনগণ সম্পৃক্ত ছিল। এটি বাংলাদেশের সর্বসম্মতভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি আন্দোলন। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম কোনো না কোনোভাবে নিজেদের ইসলামফোবিক চোখের মাধ্যমে পুরো দৃশ্যপটকে ব্যাখ্যা করছে।’

গত সোমবার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ভারতীয় গণমাধ্যমের সংবাদ নিবন্ধের আরেকটি দাবি ছিল, বাংলাদেশের বিক্ষোভ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কারণ, তারা রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। শুধু পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাই নয়, এই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে চীনা সংযোগের কথাও বলছে বেশ কিছু গণমাধ্যম এবং এগুলোর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাস্তবে এসব খবরের কোনো ভিত্তি নেই। হিন্দুদের ওপর হামলার ব্যাপারেও অতি বাড়াবাড়ি করছে দেশটির অনেক গণমাধ্যম। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, ভারত যাদের শত্রু মনে করে, সেই জামায়াত ও হেফাজতের নেতা-কর্মীরাই হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও উপসনালয় সুরক্ষা দিয়েছে বেশি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সহযোগিতার জন্য জামায়াত নেতাদের ভূমিকা ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কাওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা না ঘুমিয়ে রাতের পর রাত পাহারা দিয়ে যাচ্ছে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও উপসনালয়।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর