‘আমরা কার কাছে বিচার দিমু। আল্লাহ ছাড়া আমাগো তো কেউ নাই। গরিবের আবার বিচার আছে নাকি।’
জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) ক্যাজুয়ালটি বিভাগে গুলিতে পা হারানো ছেলে নাদিম হোসেনের পাশে বসে কথাগুলো বলছিলেন তার মা মরিয়ম বেগম। কোটা আন্দোলনের সময় কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারান নাদিম। আহত হওয়ার পর তাকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। রোববার বিকেলে সেখানে কথা হয় নাদিমের মায়ের সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমার পোলাডার সব শেষ কইরা দিল। ছোট্ট পোলা। এখন তো কিছু কইরে খাইতে পারব না। আমরা এসব কথা কার কাছে কমু। আমাকে তো আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই। কার কাছে বিচার দিমু! গরিবের আবার বিচার আছে নাকি। গরিবের আল্লাহ আছে।’
২০ জুলাই শনিবার বিকেলে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ফ্যাক্টরিতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হন নাদিম। এরপর তাকে নেওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। পায়ের অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় গত সোমবার তার গুলিবিদ্ধ পা কেটে ফেলা হয়।
১৭ বছর বয়সী নাদিমের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায়। বাবার নাম দুলাল হোসেন। নাদিম পরিবারের সঙ্গে চিটাগাং রোড এলাকায় থাকতেন। বাবা রিকশা চালায়। তারা তিন ভাই। নাদিম সবার বড়।
বিজ্ঞাপন
পরিবারের বড় ছেলে নাদিম। অভাবে তাড়নায় ৭ হাজার টাকায় একটা ছোট কাজ নিয়েছিলেন। তার বাবা অসুস্থ। এরপরও তিনি রিকশা চালান। তিন ভাই ও বাবা-মা মিলে পাঁচজনের সংসার তাদের। নাদিমের আয়ের টাকায় সংসারে বড় সাপোর্ট হতো। কিন্তু সেটাও এখন বন্ধ হয়ে যায়। নাদিম কতদিনে সুস্থ হয়ে উঠবে তা বলা মুশকিল।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে নাদিম জানান, প্রথমে তাকে খানপুরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল এরপর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার পর পঙ্গু হাসপাতালে পাঠান। এখানে আনার পর পা কেটে ফেলতে হয়েছে তার।
নাদিমের মা জানান, অভাবি সংসারে অনেক কষ্ট করে তাদের চলতে হয়। নাদিম ও তার বাবা প্রতিদিন যা আয় করত দিয়ে কোনোমতে সংসার চলত। কিন্তু এখন নাদিম বিছানায়। তাকে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা পর্যন্ত অনেক টাকা খরচ হয়েছে। আর রক্ত লেগেছে ৮ ব্যাগ। তার মধ্যে এক ব্যাগ রক্তে সমস্যার কারণে ফেলে দিতে হয়েছে। রক্তের পুরোটাই তাদের কিনতে হয়েছে। যার ব্যাগ প্রতি খরচ হয়েছে তিন হাজার টাকা। আত্মীয়-স্বজন চাঁদপুরে থাকলেও দেশের পরিস্থিতির কারণে ঢাকায় আসতে পারেননি। ফলে অন্য লোকের দ্বারস্থ হয়ে নাদিমের জন্য রক্ত কিনতে হয়েছে। পরিস্থিতি এমনটাই ভয়াবহ ছিল, রক্ত দিতে না পারলে নাদিমকে বাঁচানো কঠিন ছিল। নাদিমের ও পজিটিভ রক্ত খুঁজতে গিয়ে তাদের ঘাম ছুটে গেছে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল দৌড়াদৌড়িতে সিএনজি খরচ, রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা এবং রক্তদাতাকে টাকা দিতে হয়েছে তাদের।
নাদিমের মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ওর বাবা অসুস্থ। এখন তেমন কাজ করতে পারে না। কীভাবে এখন সংসার চলবে কিছু বুঝতে পারছি না।
নাদিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি কাজ শেষ কইরা আসতেছিলাম। মানুষের লগে দৌড় দিছি। গুলিটা পেছন থাইকা লাগছে। এরপর আমি পইড়া গেছিলাম। গুলিটা কেডা করছে আমি তো দেখি নাই। অনেকক্ষণ পইড়া আছিলাম। তারপর এক ভাই আমারে উঠাইয়া হাসপাতালে নিছে।’
নাদিম আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন তাদের দেখতে। তিনি প্রত্যেক আহত ব্যক্তিকে ১০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। সঙ্গে যাদের পা কাটা হয়েছে তাদের কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেন নাদিমকে ভালো মানের কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেন সে প্রত্যাশা করছেন তার মা মরিয়ম।
এমআইকে/এমআর