সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

জাটকা ধরতে শিশুদের ব্যবহার, সহায়তায় প্রভাবশালীরা!

কাজী রফিক, চাঁদপুর থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

জাটকা ধরতে শিশুদের ব্যবহার, সহায়তায় প্রভাবশালীরা!
নানা কৌশলে ধরা হচ্ছে জাটকা। ছবি: ঢাকা মেইল
  • জেলে-প্রশাসনের মধ্যে চলে ইঁদুর-বিড়াল খেলা
  • জাটকা ধরতে ব্যবহার করা হয় শিশুদের
  • স্থানীয় খাবার হোটেলে জাটকা বিক্রি হয় চাপিলা নামে
  • নাটের গুরু স্থানীয় প্রভাবশালীরা

চাঁদপুরের নৌ এলাকা প্রায় ৭০ কিলোমিটার। ইলিশের দেশ হিসেবে পরিচিত এই জেলায় ইলিশই যেন সবচেয়ে ঝুঁকিতে। জাতীয় মাছের প্রজনন মৌসুমে এখানে অবাধে ধরা হয় জাটকা মাছ।


বিজ্ঞাপন


জেলার মৎস্য সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, চাঁদপুরের জনসীমায় জেলে আছেন প্রায় ৪৪ হাজার। তবে তাদের মধ্যে কিছু জেলে নিবন্ধিত নন। সরকারি হিসাব মতে, জেলের সংখ্যা ৪২ হাজারের কাছাকাছি৷ যারা মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার মৌসুমে সরকারের ভিজিএফ কর্মসূচির অধীনে ৪০ কেজি হারে চাল পান।

মাছ ধরা পেশার সঙ্গে জড়িত এই জেলেদের মধ্যে অসৎ পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা যেন একটু বেশিই। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার মৌসুমে কিছু জেলে আদেশ অমান্য করেন। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে তারা নেমে পড়েন মাছ ধরতে। এ চিত্র প্রতি বছরের।

চলতি বছর জাটকা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে চাঁদপুরের নদী এলাকায় জাটকা ধরা বন্ধে নৌ-র‍্যালি করেছে মন্ত্রণালয়। এতে যোগ দেন স্থানীয় জেলে, নৌপুলিশ, কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এ সময় জেলেরা জাটকা না ধরার প্রতিশ্রুতি দেন।

তবে চাঁদপুরের অভ্যন্তরীণ চিত্র ভিন্ন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন চায়ের দোকানি ঢাকা মেইলকে বলেন, 'ইলিশের দেশে আবার ইলিশ পাইবেন না? হোটেলে যান, পাবেন। ছোট ছোট ইলিশ। সব জাটকা। চাপিলা বইলা বেচতাছে।'


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ, তবু কেন ভারত থেকে আমদানি?

একই তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় আরও কয়েকজন। তাদের ভাষ্য, জেলেরা নিয়মিতই জাটকা ধরছেন। যা স্থানীয় বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। তবে পুরো কাজটাই চলে আড়ালে-আবডালে।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, জাটকা ধরতে কয়েক ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেন স্থানীয় জেলেরা। সাধারণ সময়ে মাছ ধরতে প্রাপ্তবয়স্ক ও অভিজ্ঞ জেলেরা নদীতে যান। তবে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলাকালে নদীতে পাঠানো হয় শিশু-কিশোরদের।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মাছ ধরতে নদীতে শিশুদের পাঠানোর কারণ তাদের নামে মামলা হয় না। নৌপুলিশের কাছে আটক হলে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

এছাড়া নৌপুলিশের চোখ এড়াতে নদীতে জেলেরা নামেন রাতে৷ নৌপুলিশ যেসব জায়গা থেকে নদীতে অভিযানে যায়, সেসব ঘাটে মাঝিদের প্রতিনিধিরা অবস্থান করেন। নৌপুলিশের কোনো সক্রিয়তা চোখে পড়তেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জাটকা ধরতে যাওয়া জেলেদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়া হয়৷ ফলে নৌপুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই সটকে পড়েন জেলেরা।

Jatka3
জাটকা নিধন রোধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে নৌ-র‌্যালি। ছবি: ঢাকা মেইল

জেলেদের এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হওয়ার ও সাহস পাওয়ার পেছনে স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন আছে বলে লোকমুখে প্রচলিত। লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে অভিযোগ সব চাইতে বেশি।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী ঢাকা মেইলকে বলেন, 'এগুলো কে করায়, কারা করায় আমরা জানি। সবাই জানে। সেলিম খানের নেতৃত্বে এগুলো চলে। তাকে জিজ্ঞেস করেন। কোনো উত্তর পাবেন না। তার ক্ষমতা অনেক।'

অভিযোগের বিষয়ে সেলিম খানের সঙ্গে মুঠোফোনে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রতিবেদকের কাছ থেকে অভিযোগের বিস্তারিত জানতে চান। প্রশ্ন শুনে তিনি বলেন, 'আমি অসুস্থ, কথা বলতে চাই না।' পরে নিজেই বলেন, 'আমার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। আমি কিছু এখন বলতে চাই না।'

ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে তিনি হঠাৎই অশালীন ভাষা ব্যবহার শুরু করেন।

শুধু সেলিম খান নয়, নিষিদ্ধ মৌসুমে মাছ ধরতে জেলেদের সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হযরত আলীর বিরুদ্ধেও। এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব দায় অস্বীকার করেন এই জনপ্রতিনিধি। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমি, আমার পরিবারের কেউ এগুলোর সঙ্গে জড়িত না। এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। কেউ প্রমাণ করুক। প্রমাণ করলে তো আমার শাস্তি হওয়া উচিত।'

আরও পড়ুন

বর্ণাঢ্য আয়োজনে নিষেধাজ্ঞাকালে ইলিশ না ধরার বার্তা

এ সময় তিনি স্থানীয় সংবাদকর্মীদের থেকে তার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলেন। একই দাবি করেছেন অভিযুক্ত আরও একাধিক জনপ্রতিনিধি।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা মেইল। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে চাঁদপুরের একজন সাংবাদিক ঢাকা মেইলকে বলেন, 'সবাই এক নায়ের মাঝি। সবাই সবার বিষয়ে জানে। কিন্তু কেউ তা প্রকাশ করে না। এখানে সাংবাদিকদের একটা অংশও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নিয়ে থাকে।'

আবার নৌপুলিশের সদস্যদের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। সংস্থাটির কেউ কেউ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কিছু জেলেকে জাটকা ধরতে সহযোগিতা করেন, এমন অভিযোগও রয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, একদল নৌপুলিশ নিষেধাজ্ঞাকালে টোকেন পদ্ধতিতে জেলেদের নদীতে নামতে দেন।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চাঁদপুর নৌ অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কামরুজ্জামান। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সংস্থাটির সদস্যরা অনৈতিক কাজে জড়িত নন। বরং তারা জাটকা রক্ষায় কাজ করছেন।

নৌপুলিশের প্রতি অভিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, 'নিষেধাজ্ঞার সময় যেকোনো জাল দিয়েই মাছ ধরা নিষিদ্ধ। অভিযান শেষ হয়ে গেলেও কিন্তু শেষ হয় না। কারণ কারেন্ট জাল সারা বছরই নিষিদ্ধ। যখন অভিযান থাকে না তখন ৯৫ ভাগ জেলেই চেষ্টা করে কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরতে৷ তখন আমরা ধরি। এখন যদি অভিযোগ করে আমরা হয়রানি করি, তাহলে তো করার কিছু নাই।'

jatka2
নিষেধাজ্ঞায়ও থেমে নেই জাটকা নিধন। ছবি: সংগৃহীত

এই কর্মকর্তার দাবি, মার্চের প্রথম ১২ দিনে নৌপুলিশের অভিযানে জাটকা ধরতে নদীতে নামা তিন শতাধিক জেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে অর্ধশতাধিক মামলা।

জাটকা রক্ষায় নৌপুলিশের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কামরুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যারা আইন ভঙ্গ করে মাছ ধরে, তাদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হয় না। তাই তারা শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা শিশুদের বিষয়ে কিছুটা নমনীয়। তবে আমরা একেবারে ছাড় দিই না। তাদের অভিভাবকদের মামলায় যুক্ত করে দিই।’

আরও পড়ুন

পদ্মার ইলিশের কেন এত সুনাম

স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ছায়াতলে এই অপরাধ চলে আসছে বিষয়টি জানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। গ্রেফতার জেলেদের আটকের পর মামলাকালে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে আড়ৎদার ও প্রভাবশালীদেরও মামলায় যুক্ত করা হয় বলে জানান এই নৌপুলিশ কর্মকর্তা। বলেন, 'এদেরকে (জেলেদের) যারা চালায় তারা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অপরাধী। ওদের একটাকে যদি আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি, তাহলে অন্তত ৫০টা জেলে ঠিক হবে৷'

পুরো বিষয়টি নজরে আনা হয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আবদুর রহমানের। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, 'স্থানীয় সরকারের লোকজনকে তো যুক্ত করতে হবে৷ কিন্তু হতাশার জায়গাটা হচ্ছে, এখানে তাদের আন্তরিকতা, তাদের সদিচ্ছা কতটুকু আছে। এ ব্যাপারটা বিবেচনায় নিতে হবে। আপনি যে বিষয়গুলো বললেন, বিষয়টি খুবই প্রাকটিক্যাল।'

মন্ত্রী বলেন, 'শিশুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যারা কলকাঠি নাড়ছে, প্রয়োজনে শিশুকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া। শিশুকে বোঝাতে হবে, তোমাকে যে ব্যবহার করছে, তুমি যেন ব্যবহার না হও, এজন্য তোমার এই শাস্তি।'

কারই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর