বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ঢাকা

মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ, তবু কেন ভারত থেকে আমদানি?

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:২৮ পিএম

শেয়ার করুন:

মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ, তবু কেন ভারত থেকে আমদানি?
ফাইল ছবি

বিশ্বে মাছ উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। সরকারের দাবি অনুযায়ী, দেশ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিবছর মাছ উৎপাদন হয় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন; যেটি চাহিদার চেয়ে বেশি এবং প্রতিবছর উদ্বৃত্ত কিছু মাছ বিদেশেও রফতানি করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ রুই-কাতলের মতো বিভিন্ন মাছ আমদানি করছে, বিশেষত ভারত থেকে। এই মাছগুলো বাংলাদেশেও চাষ হয় এবং খাওয়ার জন্য বেশ জনপ্রিয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের মতো দেশগুলো থেকে কোন ধরনের মাছ, ঠিক কী পরিমাণে আসছে? আর যেখানে বাংলাদেশেই যথেষ্ট মাছ উৎপাদন হচ্ছে, সেখানে ব্যবসায়ীরা ভারত থেকেই বা কেন মাছ আমদানি করছেন?


বিজ্ঞাপন


ঢাকার বাজারে ভারতীয় মাছ

ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাছ বাজার। ক্রেতা-বিক্রেতার প্রচণ্ড ভিড়। বাজারে মাছের বড় বড় আড়ত রয়েছে। যেখানে মূলত পাইকারি দরে মাছ বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন ছোট ছোট বাজারের দোকানি কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীরা এখান থেকে মাছ কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে থাকেন।

এই বাজারে একটু ঘুরতেই চোখে পড়বে ভিন্ন ধরনের কিছু মাছ। ভিন্ন ধরনের বলতে মাছগুলো আকারে বেশ বড় এবং পলিথিনে মোড়ানো। একেকটি মাছের ওজন হবে ১০ থেকে ১৫ কেজি। বোয়াল, রুই, কাতল, কালি বাউস, আইড়সহ বিভিন্ন ধরনের মাছ বরফে সাজানো। জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো এগুলো সব ভারতীয় মাছ।

চুন্নু মৃধা নামে একজন জানালেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে এসব মাছ আমদানি করা হয়। ‘এগুলো সব ভারত থেকে আসে। সেজন্য পলিথিন দিয়ে মোড়ানো থাকে। বরফ দিয়ে ভালো করে প্যাকেট করা থাকে। এলসি খুলে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমরা নিয়ে আসি,’ বলছিলেন চুন্নু মৃধা।


বিজ্ঞাপন


ঢাকার যাত্রাবাড়ী এবং কারওয়ানবাজার থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা ভারতীয় এসব মাছ কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। অনেকে এসব মাছ ফেরি করেও বিক্রি করেন বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়।

কোন ধরনের মাছ আসে?

ভারত থেকে শুধু যে রুই-কাতলের মতো বড় মাছ আমদানি করা হয় তা নয়। এর সঙ্গে প্রচুর বাইম মাছ এমনকি ছোট জাতের কাঁচকি মাছও ভারত থেকে এনে বিক্রি হচ্ছে ঢাকার বাজারে। আসছে সামুদ্রিক মাছও।

তবে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকেও কিছু মাছ আসে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয় মূলত সামুদ্রিক মাছ।

সঞ্জীবন দাস নামে একজন বিক্রেতা জানাচ্ছেন, তাদের মাছ ভারত থেকেই বেশি আসে। এমনকি সামুদ্রিক মাছও আনা হয়।

আরও পড়ুন

খাবারের পাত থেকে ‘উঠে যাচ্ছে’ দেশীয় মাছ

‘ভারতের হায়দরাবাদ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মাছগুলো আনা হয়। ভারতের হাওর এবং বড় জলাশয়ের চাষের মাছ এগুলো। ভারতের মাছগুলো আকারে বড়। বাংলাদেশের মাছ এত বড় হয় না। দুই থেকে তিন/চার কেজি। কিন্তু ভারতের মাছ দশ কেজি থেকে ১৫/১৬ কেজি সহজেই পাওয়া যায়।’

কত মাছ আসে বিদেশ থেকে?

বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশগুলোর অন্যতম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেবে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।

এরমধ্যে ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ শীর্ষে, মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে তৃতীয়। একইভাবে বদ্ধ জলাশয়ের মাছেও দেশের অবস্থান তৃতীয়। আর সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ২৫তম।

মৎস্য অধিদফতরের হিসাবে গেল অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৯ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়েও বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে সে বছর রফতানি হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মাছ।Fish-india3

কিন্তু আমদানি কত? মৎস্য অধিদফতরের হিসাবে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাছ আমদানি হয়েছে ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে শুধু বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ২৪ হাজার মেট্রিক টন, যা মোট আমদানিকৃত মাছের প্রায় অর্ধেক। বাকি মাছ এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে।

এছাড়া অধিদফতরের হিসাবে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সার্বিক মাছ আমদানি হয়েছে এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি। এর আগের তিন অর্থবছরেও মাছ আমদানি হয়েছে গড়ে ৭০ হাজার থেকে ৯০ লাখ মেট্রিক টন।

ব্যবসায়ীরা কেন মাছ আমদানি করছেন?

বাংলাদেশে আমদানি হয় মূলত সস্তা দামের মাছ। বিপরীতে রফতানি হয় চিংড়ি এবং ইলিশের মতো দামি মাছ। ফলে গেল অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭০ হাজার মেট্রিক টন মাছ রফতানি করে আয় করছে ৪৪ কোটি ডলার। এর বিপরীতে ৫৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ আমদানি করে ডলার ব্যয় হয়েছে চার কোটি ডলার। অর্থাৎ রফতানি আয়ের তুলনায় মাছের আমদানি ব্যয় বেশ কম।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পরিমাণে কম হলেও মাছের দেশে মাছ আমদানি কেন হচ্ছে? ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে বলছেন, কম দামের কথা।

আরও পড়ুন

‘২০২১-২২ অর্থ বছরে ৫ হাজার ১৯১ কোটি টাকার মাছ রফতানি হয়েছে’

যাত্রাবাড়ীতে আব্দুল জলিল নামে এক ব্যবসায়ী বলছেন, দেশি মাছের দাম বেশি। কিন্তু ভারতের মাছের দাম কম। তিনি বলেন, ‘ইন্ডিয়ান মাছের রেট কেজিতে দুশো থেকে তিনশ টাকা পর্যন্ত কম পাই আমরা। রুই, বোয়াল, কালি বাউস কিংবা সামুদ্রিক মাছ -সবগুলোতেই ইন্ডিয়ান মাছের দাম কম। এখানে দেশি আইড় মাছ কেজিতে দেড় হাজার বা তারও বেশি দাম। কিন্তু ভারতেরটা মাত্র পাঁচশ টাকা কেজি।’

তার মতে, ভারতে মাছ চাষের জায়গা বেশি, চাষও হয় বেশি। ফলে দাম কম। কিন্তু বাংলাদেশে জায়গা কম হওয়ায় মাছ চাষে খরচ বেশি। ফলে মাছের দামও বেশি।

দাম কম হওয়ায় ‘গরিব মানুষেরা এসব মাছ কিনে খেতে পারে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় এবং বার্মিজ মাছ দেশে আসায় দেশি মাছের দামটাও ‘একটু নাগালের মধ্যে থাকে।’

ভারতীয় মাছ চিনবেন কীভাবে?

ঢাকায় একবার ভারতীয় মাছ পৌঁছানোর পর এসব মাছ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন বাজারে। কিন্তু তখন রুই-কাতল-বোয়ালের মতো মাছগুলো যে ভারত কিংবা মিয়ানমার থেকে আনা সেটা আর বোঝার উপায় থাকে না। অনেক ক্রেতাও বিদেশ থেকে বিশেষ করে ভারত থেকে আসা মাছ চিনতে পারেন না।

সাধারণভাবে বিদেশি সামুদ্রিক মাছ আলাদা করে চেনা বেশ কঠিন। তবে বিক্রেতারা বলছেন রুই, বোয়াল, কাতল, আইড়সহ এ ধরনের মাছগুলো খালি চোখে চেনা সম্ভব।

Fish-India2

খালেক মণ্ডল নামে একজন বিক্রেতা জানাচ্ছেন, দেশি মাছের রং সাধারণত উজ্জ্বল থাকে। তিনি বলেন, ‘দেশি মাছের কালার একটু লালচে হয়, উজ্জ্বল হয়। মাছটাও টাটকা থাকে। তুলনায় ইন্ডিয়ান বা বিদেশি মাছ টাটকা হয় না। এটার গায়ের রং কাৰলো হয়। মাছটা বরফে থাকে, দুই/তিন দিন সময় লাগে আসতে সেজন্য এর কালারটা একটু ডিসকালার হয়ে যায়।’

এছাড়া আরেকজন বিক্রেতা জানালেন, বোয়াল মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরটা একটু হলুদ রঙের হয়। আর ভারতেরটা হয় সাদা, ফ্যাকাশে।

আমদানি করা মাছের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কে দেখে?

পরিমাণে কম হলেও, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যে বিদেশ থেকে মাছ আমদানি করছেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতির কারণেই সেটা অবশ্য সরকারের পক্ষে একেবারে নিষিদ্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এমন বক্তব্যই দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়। এছাড়া ভারতের মতো দেশে বাংলাদেশ নিজেও মাছ রফতানি করে থাকে।

তবে মাছ আমদানির ক্ষেত্রে একজন ব্যবসায়ীকে আলাদা করে মৎস্য অধিদফতরের অনাপত্তি পত্র নিতে হয়। এছাড়া মাছ আমদানিতে শুল্কও ধরা হয়েছে উচ্চহারে। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়, যেসব মাছ আসছে, সেগুলোর মান যাচাই কতটা করা হয়?

আরও পড়ুন

হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ

জানতে চাইলে মৎস্য অধিদফতর অবশ্য বলছে, আমদানি পর্যায়ে মান যাচাইয়ের পরই বাংলাদেশে প্রবেশ করে এসব মাছ। মৎস্য অধিদফতরের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, মান যাচাই ছাড়া মাছ আমদানির সুযোগ নেই।

‘প্রথমত, যে দেশ থেকে মাছ আসছে, সে দেশের অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ থেকে প্রতিটি চালানের বিপরীতে হেলথ সার্টিফিকেট দেখাতে হয়। এছাড়া বন্দরে আসার পর মাছের যে বাহ্যিক গুণাগুণ, পচা কি না বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না, সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়। এর সঙ্গে ফরমালিন টেস্ট, হেভি মেটাল আছে কি না সেটি নির্ণয়ের জন্যও টেস্ট করে। তবেই বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়,’ বলছিলেন সিরাজুল ইসলাম।

বাংলাদেশে একসময় নদীর মাছের বাড়তি দামের কারণে মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করেছে মূলত চাষের মাছ। দেশের ভেতরে মাছ চাষ বৃদ্ধি এবং এগুলো দামে সস্তা হওয়ায় তা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন বাজারে আরও কম দামে ভারতীয় এবং মিয়ানমারের মাছ সহজলভ্য হলে এর চাহিদা যেমন বাড়বে তেমনি বাংলাদেশের মাছ চাষিরাও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কাও আছে।

তবে বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় মাছের উৎপাদন বেশি এবং সে তুলনায় আমদানি এখনও কম -স্বস্তির জায়গা আপাতত এটাই, এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। -বিবিসি বাংলা

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর