বিভিন্ন ভ্লগ আর ট্যুর গ্রুপগুলোতে নানান মানুষের কাশ্মির ভ্রমণের ভিডিও দেখতাম আর ভাবতাম কবে এমন সুযোগ আমারও আসবে, আমিও দেখবো পৃথিবীর ভূস্বর্গের সৌন্দর্য।
এ বছরের জুলাই মাসে কাশ্মির যাওয়ার প্ল্যান করি। ট্যুর প্ল্যান হওয়ার পর নিজে নিজে ভিসা ফর্ম অ্যাপ্লাই করি এবং ৩ দিনের মাথায় ১ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসাও পেয়ে যাই আলহামদুলিল্লাহ। এরপর আস্তে আস্তে ডলার কেনা, প্রয়োজনীয় ওষুধ, কাপড়চোপড়, ব্যাগ যাবতীয় সব কিছু গুছিয়ে নিলাম।
বিজ্ঞাপন
সৌদিয়ার এসি বাসে বিকাল ৫.৩০ এ বেনোপোলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি চট্টগ্রামের জিইসি থেকে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে বাস যাবে তাই সুপারভাইজারকে বলে রেখেছিলাম যাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। কারণ, স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে এতদিন টিভি আর পত্রিকাতে দেখলেও এবার সরাসরি দেখার সুযোগ এসেছে।
ভোর ৪টায় বাস বেনাপোল নামিয়ে দিল। দেখি এর মধ্যেই মোটামুটি ৩০০ এর অধিক লোক লাইনে। সকাল ৬.৩০ এ ইমিগ্রেশন চালু হবে। ততক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে রইলাম। ইমিগ্রেশন বাংলাদেশ অংশে স্মুথলি হলেও ভারতের অংশে ব্যাপক বিপত্তি পোহাতে হয়েছে। ভ্যাপসা গরম, বিদ্যুৎ ভোগান্তি সব মিলিয়ে ১২.২০ নাগাদ ইমিগ্রেশন শেষ হলো। প্রায় ৬ ঘণ্টার ভোগান্তি শেষে বেনাপোল বর্ডার থেকে টাকা আর ডলার ভাঙিয়ে নিয়ে সিএনজি দিয়ে বিখ্যাত যশোর রোড হয়ে চলে গেলাম বনগাঁ স্টেশন।
বনগাঁ থেকে ২০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে ট্রেনে চাপলাম শিয়ালদাহ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ৩ ঘণ্টার ট্রেন জার্নির পর শিয়ালদাহ স্টেশন হতে বের হতেই চোখ যতদূর যায় ততদূর দেখা যায় সব হলুদ ট্যাক্সি। ১৫০ রুপি দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে গেলাম মার্কুয়িস স্ট্রিট। সেখানে হোটেল ঠিক করে সবাই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতা শহর ঘুরে দেখতে।
বিজ্ঞাপন
>> আরও পড়ুন: প্রাণবন্ত তিলোত্তমা ‘কলকাতা’, ঘুরবেন কোথায়?
নবাব হোটেলে মাত্র ৪৫ রুপি দিয়ে গরুর মাংস পাওয়া যায়, যা দিয়ে ভরপেট খেলাম সবাই। এরপর কলকাতা শহরে পায়ে হেঁটে বিকাল অবধি ঘুরলাম মার্কুয়িস স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট। একটা সিম কিনে চলে গেলাম নিউ মার্কেট। সেখান থেকে শপিং শেষে কিছু স্ট্রিট ফুড ট্রাই করে একটা ট্যাক্সিতে উঠলাম।
এবার গন্তব্য বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ যা ভারতীয় বাংলা মুভিতে বহুবার দেখেছি ছোটবেলা থেকে। বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ পায়ে হেঁটে পার হয়ে আরেকটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম হোটেলে। এবার বিশ্রাম নেওয়ার পালা। কারণ পরেরদিন দুপুর বেলা জম্মুর ট্রেন ধরতে হবে এবং এই ট্রেনে থাকতে হবে একটানা ৩৬ ঘণ্টা।
ভারতীয় রেল একটি আস্ত চলন্ত দুনিয়া। এই ৩৬ ঘণ্টার জার্নিতে এটা খুব ভালোই উপভোগ করেছি। ফরেনার জানার পর তারা অনেকে নিজ থেকে আড্ডা জমাল। তাদের সাথে থাকা খাবার অফার করল। অনেকে তো একধাপ এগিয়ে ট্রেনে আমাদের খাবার বিল পরিশোধ করে দিতে একরকম জোরাজোরি করছিল। চলতে চলতে একে একে ক্রস করছিলাম ধানবাদ, ইউপি, পঞ্জাব, হারিয়ানাসহ ভারতের বিখ্যাত সব প্রদেশসমূহ।
রাত ১১টা নাগাদ পৌঁছালাম জম্মু রেলস্টেশনে। রাতটা সেখানেই কাটাতে হবে কারণ সকালের আগে কোনো গাড়ি চলবে না। ভোর বেলা বেরিয়ে গেলাম গাড়ি খোঁজার উদ্দেশ্য। লোকাল বাসে চলে এলাম বাস স্টেশনে। সেখান থেকে জনপ্রতি ৩৫০ রুপিতে উঠে গেলাম বাসে। গন্তব্য এবার বানিয়াল রেলস্টেশন।
সাড়ে ৫ ঘণ্টার জার্নি একেবারেই বিরক্তি লাগেনি নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার বদৌলতে। বানিয়াল পৌঁছে দুপুরের খাবার সেরে নিয়েই ২৫ রুপি দিয়ে ট্রেনের টিকেট কেটে চেপে বসলাম জম্মু কাশ্মিরের রাজধানী শ্রীনগরের উদ্দেশ্য। বিকাল নাগাদ পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের কাশ্মিরে। সেখান থেকে সরাসরি কাইয়ুম চকে গিয়ে একটি গেস্ট হাউসে উঠলাম পার নাইট ৮০০ টাকা চুক্তিতে।
>> আরও পড়ুন: জলকাণ্ডেশ্বর মন্দির: অপূর্ব শিল্পকর্মে পরিপূর্ণ প্রাচীন স্থাপনা
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাবার খেতে। সেসঙ্গে চারপাশটাও একটু ঘুরে দেখতে। পরের দিন সকাল বেলা নামকিন চায়ের সাথে কাশ্মিরি স্পেশাল রুটি দিয়ে নাশতা সেরে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম ৮০০ রুপি চুক্তিতে শ্রীনগর সাইটসিয়িং এর উদ্দেশ্যে। একে একে ঘুরে দেখলাম মোঘলশাহী গার্ডেন, নিশাতবাগ গার্ডেন, পরিমহল, চাশমিসাহি গার্ডন, বাদাম ওয়ারী, শ্রীনগর জামা মসজিদসহ নানান জায়গা।
বিকাল বেলা ৭০০ রুপিতে সেরে নিলাম ডাললেকের বিখ্যাত শিকারা রাইড। রাতে বের হয়ে পরিবারের জন্য কাশ্মিরি শাল কিনে গেস্ট হাউসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম পরেরদিন লম্বা সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে।
ভোর বেলা ২৫০০ রুপিতে কার ভাড়া যাত্রা করলাম পেহেলগামের উদ্দেশ্য। কিছুদূর যাত্রার পর দেখা পেলাম বিখ্যাত লিডার রিভারের। যাত্রাপথে রাস্তার দুপাশে চোখে পড়বে সারি সারি আপেল বাগান। পেহেলগাম পৌঁছে হোটেল ঠিক করে পায়ে হেঁটেই যাত্রা করলাম বাইসারান ভ্যালির উদ্দেশ্য যাকে মিনি সুইজারল্যান্ড ও বলা হয়ে থাকে। কেউ চাইলি পনি রাইডেও সেখানে যেতে পারে তবে আমরা পায়ে হেঁটেই যাবো মনস্থির করেছিলাম।
প্রায় ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট পাহাড় বেয়ে দেখা মিলল বাইসারান ভ্যালির। এতো সুন্দর জায়গাটি ছেড়ে সহজে নিচে নামতে মন সায় নিচ্ছিল না। সেখান হতে পেহেলগাম টুরিস্ট ট্যক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে ১৯০০ রুপিতে একটি সমো গাড়ি ভাড়া নিলাম অরু ভ্যালি আর বেতাব ভ্যালি ঘুরে দেখার উদ্দেশ্য।
>> আরও পড়ুন: দিন-দুপুরে দার্জিলিংয়ে
পরেরদিন ভোরবেলা উঠেই ৫০০০ রুপিতে গাড়ি রিজার্ভ করলাম গন্তব্য এবার সোনমার্গে। সেখানে পৌঁছে ৬০০ রুপিতে হোটেল ঠিক করে বেড়িয়ে পড়লাম জিরো পয়েন্টে গিয়ে বরফ দেখতে। জুলাই মাসেও এখানে ভালোই ঠান্ডা এবং পাহাড়ের ওপরের অংশে বরফের অস্তিত্ব থাকে।
ঘন্টাদেড়েক পায়ে হেঁটেই দেখা মিলল গ্লাসিয়ারের। প্রথমবার প্রাকৃতিক বরফ ছুঁয়ে দেখার আনন্দে আত্মহারা ছিলাম খানিক্ষণ। এরপর হোটেলে ফিরে এসে কিছুক্ষণ ম্যানেজারের সাথে আড্ডা দিয়েই ঘুমাতে গেলাম।
সম্রাট জাহাঙ্গীর বলেছিলেন পৃথিবীর বুকে কোথাও স্বর্গ থাকলে এটা কাশ্মিরেই। নিজ চোখে কাাশ্মির দেখার পর মনে হচ্ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীর ভুল কিছু বলেননি। এভাবেই শেষ হলো আমার স্বপ্নের কাশ্মির যাত্রা।
অনেকেই মনে করেন কাশ্মির ভ্রমণে ব্যাপক টাকা পয়সার প্রয়োজন। এটা ভুল ধারণা। একটু পরিকল্পনা করে গেলেই ২৫০০০ টাকার মধ্যেই কাশ্মির ভ্রমণ করা সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
এনএম