নিপাহ ভাইরাস একটি জুনোটিক ভাইরাস। অর্থাৎ পশু থেকে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসটি এসেছে। প্রতিবছর নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়। এই রোগটি কেন হয়, কীভাবে ছড়ায়, লক্ষণ কী, এর চিকিৎসা কী— এসব নিয়েই এই প্রতিবেদন।
নিপাহ ভাইরাস মস্তিষ্ক বা শ্বসনতন্ত্রে প্রদাহ তৈরির মাধ্যমে মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করে। এটি Henipavirus জেনাসের অন্তর্গত একটি ভাইরাস। এই ভাইরাসের কারণে এনসেফালাইটিস নামক মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ হয়। নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহক ফলখেকো বাদুড়। তবে শূকরও এই ভাইরাস বহন করে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শূকরের খামারে কাজ করা চাষীদের মাধ্যমে প্রথম ছড়িয়েছিল ভাইরাসটি। আক্রান্ত শূকরের স্পর্শ, তাদের লালা এবং সংক্রমিত মাংসের মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটে। পরবর্তীতে রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে।
নিপাহ ভাইরাস কতটা জটিল?
নিপাহ ভাইরাসকে বেশ জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা বলা যায়। কেননা এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পান, তবে তার মৃত্যু পর্যন্তও হতে পারে। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সংক্রমিত হওয়ার ৪-১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়। ৩-১৪ দিন এসব লক্ষণ স্থায়ী হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি আক্রান্ত ব্যক্তির সঠিক চিকিৎসা করা হয়, তবে তার জীবন বাঁচানো যেতে পারে। অন্যথায় মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।
আরও পড়ুন- শীতে বাড়ে বাতের ব্যথা, কমাতে করণীয়
কীভাবে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়?
মূলত, বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ অন্যান্য পশুর দেহে ও মানব শরীরে ছড়ায়। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে শূকর থেকেও এটি সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার নিপাহ ভাইরাসে কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত হলে তার সংস্পর্শে থাকা অন্যজনেরও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ কী?
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো-
জ্বর
মাথাব্যথা
কাশি
গলা ব্যথা
শ্বাসকষ্ট
বমি
নিপাহ ভাইরাসের নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়-
তন্দ্রা বা বিভ্রান্তি
খিঁচুনি
কোমায় চলে যাওয়া
এনসেফালাইটিস
গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে, রোগী মৃত্যুর হার ৪০-৭৫ শতাংশ। এমনকি যারা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর বেঁচে থাকে তাদেরও দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। অনেকসময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘ সময় অর্থাৎ মাস এমনকি বছর পর মারা যায়।
আরও পড়ুন- ভাইরাল সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায়
নিপাহ ভাইরাস কীভাবে নির্ণয় করা হয়?
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ সাধারণত কেবল লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। তবে এটি নিশ্চিত করতে RT-PCR পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে শরীরের তরল পরীক্ষা করা হয়। ELISA পরীক্ষার মাধ্যমেও নিপাহ ভাইরাস নির্ণয় করা হয়।
নিপাহ ভাইরাসের চিকিৎসা
নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ সেভাবে পাওয়া যায়নি। WHO এর মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যত্নই একমাত্র সমাধান। এজন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ বিশ্রাম নিতে এবং প্রচুর পানি ও তরল পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়, যাতে রোগী উপসর্গ থেকে মুক্তি পায়।
নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায়
নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচতে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে। এগুলো হলো-
খেজুরের কাঁচা রস বা তাড়ি না খাওয়া
খেজুরের কাঁচা রসে ডুবিয়ে পিঠা বা অন্য খাবার না খাওয়া
রস ভালোভাবে টগবগিয়ে ফুটিয়ে বা গুড় বানিয়ে খাওয়া
আধা খাওয়া ফল না খাওয়া, কেননা বাদুড়ের আধাখাওয়া ফল থেকে নিপাহ ছড়াতে পারে
যেকোনো ফল ধুয়ে খাওয়া
সবধরনের ধোয়া-মোছার কাজে সাবান ব্যবহার করা, কেননা সাবান ব্যবহারে নিপাহ ভাইরাস মারা যায়
নিপাহ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। তাই আক্রান্ত এলাকায় কারো মধ্যে এর লক্ষণসমূহ দেখা দিলে মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করে চিকিৎসা নিতে হবে।
এনএম