শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে হিমশীতল কাঁচা খেজুরের রস পান বাংলার চিরচেনা একটি ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ধারণ করে গ্রামের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড়বড় শহরগুলোতেও নানা আয়োজনে পান করা হয় খেজুরের রস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও আয়োজন করা হয় রস উৎসব। তবে খেজুরের কাঁচা রস পান করাকে অত্যন্ত বিপদজনক বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এতে মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকিসহ স্থায়ী পঙ্গুত্বের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে উল্লেখ করে খেজুরের কাঁচা রস পান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এমন পরামর্শের কারণ নিপাহ ভাইরাস। এ ভাইরাসের বাহক টেরোপাস (ফল আহারি) গোত্রের বাদুড়। বাদুড় থেকে মানুষের দেহে এই রোগের সংক্রমণ হয়। মানুষের মধ্যে এ সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় মালয়েশিয়ায় ১৯৯৮ সালে, যা শূকর থেকে মানুষের সংক্রমিত হয়েছিল। তবে শূকরের দেহে এ রোগের সংক্রমণ হয়েছিল বাদুড় থেকে। বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত হয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশে পাওয়া সংক্রমণের সব ঘটনায় রোগীদের খেজুরের কাঁচা রস পানের ইতিহাস ছিল। এই রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুহার প্রায় ৭০ শতাংশ। আর প্রাণে বেঁচে গেলেও দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক রোগে ভুগতে হয়।
বিজ্ঞাপন
দেশে নিপাহ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে শীত মৌসুমে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সাধারণত খেজুরের কাঁচা রস পানের মাধ্যমে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়। চলতি বছর (২০২৩) এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১০ জন। রোগী অনুপাতে মৃত্যুহার ৭১ দশমিক ৪২ শতাংশ। যা গত সাত বছরে সর্বোচ্চ। নতুন করে মারা যাওয়ার মধ্যে একজন নবজাতকও রয়েছেন। গর্ভাবস্থায় নবজাতকের মা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। জন্মের পর শিশুটিরও নিপাহ শনাক্ত হয়। এতে মায়ের জীবন রক্ষা পেলেও বাঁচানো যায়নি নবজাতককে। আর আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫ জন পাওয়া গেছে নওগাঁ জেলায়। এরপরই রয়েছে রাজবাড়ী জেলা, সেখানে ৪ জনের দেহে নিপাহ শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া চলতি বছর প্রথমবারের মতো নরসিংদীতে নিপাহ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩৯ জন নিপাহ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশের মোট ৩৪ জেলায় ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭১ জন রোগী পাওয়া গেছে ফরিদপুর জেলায়। আর আক্রান্তদের মধ্যে ২৪০ জন মারা গেছেন।
বিজ্ঞাপন
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) দেওয়া তথ্য মতে, দেশে নিপাহর সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে ২০০৪ সালে। ওই বছর মোট ৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছিল, মারা যান ৫০ জন। ২০১১ সালে আক্রান্ত হয় ৪৫ জন, যার মধ্যে ৩৭ জন মারা যান। ২০০২, ২০০৬ ও ২০১৬ সালে আক্রান্ত ও মৃত্যুর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
বাংলাদেশের বাইরে সাম্প্রতিককালে ভারতের কেরালাতে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারতে ১০১ জন আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৪ জন। রোগী অনুপাতে মৃত্যুহার প্রায় ৭০ শতাংশ।
খেজুরের কাঁচা রস ও নিপাহ
নিপাহ ভাইরাসের বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— এটি কিভাবে ছড়ায়? খেজুরের কাঁচা রসের বিষয়েই কেন এত আলোচনা?
২০০৫ সালে নিপাহ সংক্রমণকালে টাঙ্গাইলে একটি গবেষণা পরিচালনা করে আইইডিসিআর। গবেষণায় দেখা যায়, খেজুরের কাঁচা রস থেকে নিপাহ ভাইরাস মানুষে সংক্রমিত হয়। এ ছাড়াও বাদুড়ের মুখের লালা বা বাদুড়ের মল-মূত্র দ্বারা দূষিত তালের রস বা তাড়ি ও আংশিক খাওয়া ফল মানুষ খেলে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। বাংলাদেশে গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে, মানুষ থেকে মানুষে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কোনোক্রমেই খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া যাবে না। যে কোনো ফল ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে। গাছের নিচে পড়ে থাকা আধা খাওয়া কিংবা ফাটা ফল খাওয়া যাবে না।
এ অবস্থায় প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে খেজুরের কাঁচা রস পানে বিধিনিষেধ আরোপেরও দাবি অনেকের। এ বিষয়ে সম্প্রতি আইইডিসিআর আয়োজিত আলোচনা স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার বিষয়টি আমরা যতদিন আইনি বিধির মধ্যে না আনব তা কতটা কার্যকর হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। খাবেন না বললেই মানুষ খেজুরের রস খাবে না, তা নয়। এই বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা যায় কি তা বিবেচনা করতে হবে।
একই অনুষ্ঠানে হাসপাতাল শাখার পরিচালকের বক্তব্যকে সমর্থন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও নিপসমের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তাই দ্রুত শনাক্ত হলেই বেঁচে যাবেন তা বলা কঠিন। আর যারা বেঁচে যান তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না। এর কোনো প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। অর্থাৎ প্রতিরোধ ছাড়া নিপাহ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। আমরা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হই। নিজে না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও যখন রস উৎসব বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে থাকি তখন ঠিকই খেজুরের রস খাচ্ছি। এটি বন্ধের জন্য প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও পড়ুন
নিপাহ ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়, কতটা জটিল?
৭ বছরে সর্বোচ্চ নিপাহ সংক্রমণ, সতর্ক হওয়ার তাগিদ
‘নিপাহ ভাইরাস ঝুঁকিতে সারাদেশ’
জীবন বাঁচলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন না রোগীরা
নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুহার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ আক্রান্তদের বেশিরভাগই মৃত্যুবরণ করেন। শঙ্কার বিষয় হলো, যারা বেঁচে যান তারাও ফিরতে পারেন না স্বাভাবিক জীবনে। চিকিৎসকরা জানান, নিপাহ ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কে আক্রমণ করে। ফলে প্রাণে বেঁচে গেলেও রোগীরা নানা নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়বিক সমস্যায় ভোগেন। অর্থাৎ স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ভাইরলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শারমিন সুলতানা ঢাকা মেইলকে বলেন, নিপাহ ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কে ইনফেকশন ঘটায়। এটি রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং সেখানে সমস্যা তৈরি করে। যে জায়গায় বেশি ছড়াবে সেখানেই বেশি প্রভাব ফেলবে। এজন্য দেখা যায় নিপাহ আক্রন্ত রোগীরা অজ্ঞান হয়ে যায়। কেননা তাদের মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার মস্তিষ্কের যে জায়গা আক্রান্ত হয় তার সেই অংশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইনফেকশনের স্থান অনুযায়ী তার পরবর্তী সমস্যাগুলোও হয়ে থাকে। নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কারো মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। কারো দেখতে সমস্যা হয়, অনেকে হাটার সময় ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেন, কারো কারো ভুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিউরোলজিক্যাল রোগে ওষুধের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায় না। এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয়। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়, তবে একদম সুস্থ হয়ে যাবে এমন নয়। তাই নিপাহ যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এমএইচ/