-
- নানা সংকটে ধুঁকছে রেলওয়ের ১০টি হাসপাতাল
- চিকিৎসা নেন না খোদ রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরাই
- সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তুতি
- ঢেলে না সাজালে আস্থা ফিরবে না: বিশেষজ্ঞ
রাজধানীর কমলাপুরে অবস্থিত ৭৫ শয্যার রেলওয়ে হাসপাতাল। জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা হাসপাতালটিতে নেই যন্ত্রপাতি ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য লোকবল। প্রায় রোগীশূন্য নিরিবিলি একটি দালান, অন্য সরকারি হাসপাতালের মতো নেই কোনো কোলাহল। হাসপাতালটিতে শুধু নেই আর নেই। হাসপাতালটি অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে বছরের পর বছর ধরে। যদিও হাসপাতালের বাগান দেখে যে কারও হৃদয় জুড়াবে, মন চাইলে আরও কিছুক্ষণ থাকি।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের সব সাধারণ ওয়ার্ডই ফাঁকা। সিটে রোগী নেই বললেই চলে। ৭৫ শয্যার হাসপাতালে রোগী ভর্তি মাত্র তিনজন। রোগীর শয্যা পড়ে আছে বারান্দায়। জরুরি বিভাগে নেই কোনো রোগী। পড়ে আছে অ্যাম্বুলেন্স। হাসপাতালটিতে নেই আধুনিক রোগ নির্ণয়ের কোনো সুবিধা, রয়েছে আদিকালের এক্স-রে মেশিন, তাও ঠিক মতো কাজ করে না। নেই জটিল কোনো রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। হাসপাতালটিতে সুন্দর অবকাঠামো থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না।
হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, একজন শুয়ে আছেন, নেই কোনো চিকিৎসক কিংবা নার্স। আবার কোনো কোনো ওয়ার্ডে নেই কেউ। এছাড়া অন্যান্য চিকিৎসক, টেকনিশিয়ানদের রুমে গিয়ে কর্মব্যস্ত সময়ে অলস বসে থাকতে দেখা গেছে। হাতে নেই কাজ, আবার কেউ কেউ গল্প করে সময় পার করছেন।
জানা গেছে, ৭৫ বেডের হাসপাতালটিতে নয়টি কেবিন ও নয়টি ওয়ার্ড রয়েছে। কিন্তু নেই পর্যাপ্ত নার্স। মোট ছয়জন নার্স দিয়ে চালানো হয় সেবা। ছয়জন ডাক্তার দিয়ে চলে কোনো রকমে সেবার কাজ। নেই কোনো কনসালটেন্ট, ২৪ ঘণ্টার ইর্মাজেন্সির জন্য রয়েছে মাত্র একজন চিকিৎসক। এছাড়া হাসপাতালটিতে ফাঁকা রয়েছে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদ, নেই পর্যাপ্ত লোকবল।
হাসপাতালটির পরিচালক ও বালাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম ডেইজি ঢাকা মেইলকে বলেন, এখানে রোগীরা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা পান এবং ওষুধপত্রও দেওয়া হয়। জরুরি কোনো সেবার ব্যবস্থা নেই হাসপাতালে। আউটডোরে রোগী হয় প্রতিদিন ৮০-১০০ জন গড়ে, কম-বেশিও মাঝে মাঝে হয়।
তিনি জানান, এখানে সব মেডিকেল অফিসার পদ, নেই কনসালটেন্ট পদ। ইর্মাজেন্সি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেই। শুধু বুকের এবং পায়ের এক্স-রে করা যায়, তাও মেশিন অনেকে আগের। এছাড়া অন্যান্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না। কিছু যন্ত্রপাতি আসার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, এই হাসপাতালগুলো শুধু রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। যদিও জনসাধারণ গেলে দেওয়া হয় সেবা। তবে জনসাধারণকে ওষুধপত্র দেওয়া হয় না। এই হাসপাতালের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় রেলওয়ের সব কর্মচারীও নেন না সেবা।
এমন অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার চিত্র শুধু কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালের নয়, এটি দেশের সব রেলওয়ে হাসপাতালের। তথ্যমতে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, পাকশী, লালমনিরহাট ও সৈয়দপুরে রেলওয়ে হাসপাতালসহ সারাদেশে রেলওয়ের অধীনে ১০টি হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালগুলোর শয্যাসংখ্যা প্রায় ৩০০। তবে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় রোগীশূন্য থাকে হাসপাতালগুলো।
কমলাপুর রেলওয়ের হাসপাতালের পাশে রয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেখানে প্রায় সব সময়ই ভর্তি রোগী দিয়ে থাকে ঠাসা, খালি থাকে না বেড। কারণ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকায় রোগীদের আস্থায় পরিণত হয়েছে মুগদা হাসপাতাল। রোগের শয্যা পেতে পোহাতে বেগ। অথচ রেল মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত রেলওয়ে হাসপাতালগুলো।
১০ হাসপাতাল নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত, আস্থা ফেরানোর চ্যালেঞ্জ
চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে গত ১১ এপ্রিল রেল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালটি ঘুরে দেখলাম। এই ধরনের হাসপাতাল দেশের আরও বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর চাপে শয্যা খালি থাকে না। কিন্তু এখানে (রেলওয়ে হাসপাতাল) শয্যাগুলো খালি পড়ে আছে। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয় সমঝোতা স্মারক চুক্তি করবে। দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ পরিচালনায় পরিচালিত রেলওয়ে হাসপাতালগুলো হবে এবং হাসপাতালগুলো জনসাধারণ জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এর আওতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসক, খাবার, যন্ত্রপাতি ও ওষুধ দেবে।’

পরে হাসপাতালগুলো জন্য সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য গত ২১ এপ্রিল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান সচিবালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অডিটোরিয়ামে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে সই করেন। এসময় রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, সমঝোতা স্মারক সই হলেও হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
রেলওয়ে হাসপাতালগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেও এসব হাসপাতাল কতটা রোগীদের আস্থা ফেরাতে পারবে সেটা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, রেলওয়ের হাসপাতালগুলো রোগীদের জন্য দিতে হবে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, দূর করতে হবে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য লোকবল সংকট। রাখতে হবে অত্যাধুনিক ল্যাব সুবিধা। তাহলেই জনসাধারণের আস্থায় পরিণত হবে রেলওয়ে হাসপাতালগুলো এবং আশার আলো খুঁজে পাবে দুই মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারক চুক্তির মাধ্যমে। এতে সুফল ভোগ করবেন দেশের মানুষ।
জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, আগে একসময় রেলওয়ে কর্মচারীদের চিকিৎসা সেবার আস্থা-ভরসায় ছিল এবং রোগীতে ভরপুর ছিল রেলওয়ে হাসপাতালগুলো। সময়ের ব্যবধানে সুযোগ-সুবিধা আর সেবার মান না থাকায় এখন রেলওয়ের কর্মচারীরাই সেবা নেন না হাসপাতালগুলোতে। আর কীভাবে জনসাধারণের আস্থায় পরিণত হবে? হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো রয়েছে। নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, নানা সংকট আর অনিয়ম।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন যেহেতু জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে, হাসপাতালগুলোর সংকট দূর করে ঢেলে সাজাতে হবে, নিয়োগ দিতে হবে পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য লোকবল। আর এজন্য দরকার স্বাস্থ্য ও রেল মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা। এই দুই মন্ত্রণালয় চাইলে ঢেলে সাজানো সম্ভব রেলওয়ে হাসপতালগুলো।
ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, হাসপাতালগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার হাসপাতালগুলোর কিছুটা হলেও চাপ কমবে। এই হাসপাতালগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য জনবল নিয়োগ দিতে হবে। সেইসঙ্গে চিকিৎসা সেবার মান উন্নত করতে হবে এবং সেবা নেওয়ার জন্য আগ্রহী করে তুলতে হবে। যেহেতু এই হাসপাতালগুলো দীর্ঘ সময় ধরে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় ভুগছে এবং এখন এই হাসপাতালগুলোর এমন পরিস্থিতি এখন রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝেই হারিয়েছে আস্থা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে দুই মন্ত্রণালয় কাজ করছে। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে এবং হাসপাতালগুলোকে সেবা দেওয়ার মতো করে তোলা হবে। সেইসঙ্গে রেলওয়ে হাসপাতালগুলোতে কীভাবে ভালো সেবা দেওয়া যায়, সে বিষয়টি দেখা হবে।’
এসএইচ/জেবি

