মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫, ঢাকা

বাংলাদেশে এসে সার্জারি শিখছেন মালয়েশিয়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক!

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

বাংলাদেশে এসে সার্জারি শিখছেন মালয়েশিয়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক!

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত পিছিয়ে থাকার অনেক গল্প সবার জানা। তবে সীমিত সামর্থে্যর মধ্যেও দেশে এই খাতে আছে সফলতার নানা গল্প। বিদেশের শিক্ষার্থীরা মেডিকেলে পড়তে বাংলাদেশে আসেন- সেই গল্প পুরনো। এবার বিদেশ থেকে খোদ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসেছেন সার্জারি শিখতে। হ্যাঁ, শুনতে অবিশ্বাস্য শোনা গেলেও এটাই বাস্তব। দাগবিহীন থাইরয়েড সার্জারির প্রশিক্ষণ নিতে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছেন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. বিনসেন্ট ট্যান।

কুয়ালালামপুরের বাসিন্দা ও কেপিজে ক্লাং বিশেষায়িত হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট এই চিকিৎসক ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও থাইল্যান্ডের মতো দেশে এই সার্জারির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু সেসব অভিজ্ঞতা তার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এবার আশার আলো নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে—শেখার জন্য বেছে নিয়েছেন জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের অভিজ্ঞ সার্জন ডা. মো. মাহবুব আলমকে।


বিজ্ঞাপন


জানতে চাইলে ডা. ট্যান ঢাকা মেইলকে বলেন, 'বাংলাদেশে এসে মুগ্ধ হয়েছি। শুনেছিলাম, ডা. মাহবুব আলম দাগবিহীন থাইরয়েড সার্জারিতে দক্ষ—এখানে এসে নিজের চোখে দেখে সেটার সত্যতা পেলাম। অন্য দেশে ছোট আকারের থাইরয়েডে এই সার্জারি হয়, কিন্তু বাংলাদেশে বড় থাইরয়েডেও দাগবিহীনভাবে অপারেশন হচ্ছে—যা সত্যিই অসাধারণ।'

malaysia-doctor2

১৪ দিনের প্রশিক্ষণে ডা. ট্যান শিখছেন এই নতুন প্রযুক্তি। প্রতিটি দিন কাজে লাগাচ্ছেন নিজের দক্ষতা বাড়াতে। তার ভাষায়, 'যন্ত্রপাতি ও জনবলের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখানকার চিকিৎসকরা যেভাবে কাজ করেন, তা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে—মালয়েশিয়ায় ফিরে গিয়ে আমিও পারবো এই সার্জারি করতে।'


বিজ্ঞাপন


মালয়েশিয়ায় থাইরয়েডের দাগবিহীন সার্জারির চর্চা এখনো সীমিত। তাই সেখানে এই প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করতে চান ডা. ট্যান। তার আশা, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজ দেশে রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দিতে পারবেন।

'বাংলাদেশে এসে বুঝলাম, শেখার জন্য শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন সঠিক গাইডেন্স আর আন্তরিকতা—যা এখানে পূর্ণমাত্রায় পেয়েছি,'—বললেন তিনি।

আরও পড়ুন

সুফল মিলছে না দেড় হাজার কোটি টাকার বিশ্বমানের হাসপাতালটির

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের এমন অর্জন নিঃসন্দেহে গর্বের। বিদেশি চিকিৎসকদের আগমন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণই বলে দেয়—এখন আর বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই, বরং দক্ষ নেতৃত্ব ও সেবার মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যখাতে সূচনা হবে নতুন এক দিগন্ত।

জানতে চাইলে বাংলাদেশে দাগবিহীন এন্ডোসকপি থাইরয়েড সার্জারির প্রশিক্ষক ডা. মাহবুব আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশের চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বিদেশ যান। কিন্তু বিদেশ থেকে চিকিৎসক বাংলাদেশের এসেছেন থাইরয়েডের সার্জারি শিখতে। এটা আমাদের জন্য খুবই গর্বের বিষয় এবং বড় অর্জন। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে এবং সে বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। কিছুদিন আগে ক্রিকেটার তামিম ইকবাল সিবিআর হার্ট অ্যার্টাক করেন, তাকে চিকিৎসা দিয়েছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। বাংলাদেশেও ভালো চিকিৎসা করা সম্ভব।’

malaysia-doctor3

উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এই সার্জারির গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন রোগীদের কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে দাগবিহীন থাইরয়েড সার্জারি। থাইরয়েডের রোগীরা এখন বলেন, কেটে সার্জারি করবেন নাকি না কেটে সার্জারি করবেন। এই সার্জারিতে কাঁটাছেড়া কম, গলার বাইরে থাকে না দাগ। সেইসঙ্গে অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতা ও ব্যথা কম।’

ডা. মাহবুব আলম বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আসেন মেডিকেলে পড়াশোনা করতে। এছাড়া বিদেশ থেকেও রোগী আসেন বাংলাদেশে। জাতীয় বার্ন প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে কয়েক মাস এক রোগী সার্জারি করতে এসেছেন ভুটান থেকে। বাংলাদেশের প্রবাসীরাও নিয়মিতভাবে দেশে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দেশে চিকিৎসা খরচ কম এবং সহজলভ্য। আর বিদেশে লম্বা সিরিয়াল থাকে, দেখা যায়- ছয় মাস পর সার্জারির তারিখ পড়ে, কিন্তু বাংলাদেশে খুবই সহজে সার্জারি করা যায়। চাইলে কিছুদিন পরই সার্জারির তারিখ পাওয়া যায়।’

আরও পড়ুন

সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অন্তরায় আস্থা ও নিরাপত্তা সংকট!

বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, ‘কোনো চিকিৎসক চিকিৎসায় ভুল করুক আর না করুক; অভিযোগ উঠলেই ঢালাওভাবে নিউজ করা হয়। পরে দেখা যায়, যিনি ভুল করেছেন, তিনি ডাক্তারই ছিলেন না; ছিলেন পল্লী চিকিৎসক বা সামান্য কোয়াক চিকিৎসক দিয়ে সার্জারি করা হয়েছে, সেখানে ভুল হয়েছে। এজন্য চিকিৎসকদের ইতিবাচক ও সফলতার দিকগুলো মানুষের মাঝে তুলে ধরতে হবে। তাহলে মানুষের মাঝে চিকিৎসকরা আস্থার জায়গা ফিরে পাবেন।’

ডা. মাহবুব আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের চিকিৎসার মান ভালো বলেই বিদেশের চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ নিতে আসছেন। এটি বাংলাদেশের মানুষকে জানতে হবে, দেশেই ভালো চিকিৎসা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বেসরকারি খাতের চিকিৎসার মান উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ব্যবসায়িক দিক নয়, মানবসেবার দিকটাও দেখতে হবে। তাহলে এগিয়ে যাবে স্বাস্থ্যখাত।’

malaysia-doctor1

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক হলো প্রচুর রোগী রয়েছে। অন্য দেশে রোগীর সংকট থাকে, কিন্তু দেশে রোগীর কোনো সংকট নেই। যেমন ধরেন- মালয়েশিয়া কোনো চিকিৎসক সার্জারি করতে হলে তাকে অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের দক্ষতাও অনেক, দেশের চিকিৎসকরা অনেক রোগী দেখেন এবং অনেক সার্জারি করেন। দেশে বিশাল মানবসম্পদ থাকার কারণে চিকিৎসকরা সহজেই দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।’

আরও পড়ুন

কেন বিদেশমুখী বাংলাদেশি রোগীরা?

জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট পাঁচ কোটি মানুষ থাইরয়েডজনিত রোগে আক্রান্ত। তিন কোটি মানুষ জানেন না, তাদের এই সমস্যা আছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৩-৫ শতাংশ মানুষ থাইরয়েড সমস্যা নিয়ে ভোগেন। এরমধ্যে ২০২২ সালে ডা. মাহবুবের হাত ধরে দেশে প্রথমবারের মতো শুরু হয় দাগবিহীন এন্ডোসকপি থাইরয়েড সার্জারি। এরপর থেকে দিন দিন রোগীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই পদ্ধতি। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের দাগবিহীন থাইরয়েড সার্জারির প্রশংসা। এখন পর্যন্ত ১০০ জন রোগীর দাগবিহীন এন্ডোসকপি থাইরয়েড সার্জারি করেছেন ডা. মাহবুব।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর