- বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার তালিকায় দশম বাংলাদেশ
- সর্বোচ্চ ৫১ শতাংশ রোগী যায় ভারতে
- রোগ নির্ণয় ও নিয়মিত চেকআপে যায় ৫৩ শতাংশ
- বেশি বাইরে যান ক্যানসার ও হার্ট রোগীরা
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ণব (ছদ্মনাম)। আর দশটা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ার মতোই প্রাণোচ্ছল ছিল তার জীবন। তবে ২০১৭ সালে তার স্বাভাবিক জীবনে ছেদ পড়ে। পায়ের জয়েন্টে তীব্র ব্যথায় জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে তার। চিকিৎসায় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ধরা পড়ে অর্ণবের। যা এক সময় তাকে শয্যাশায়ী করে দেয়। দেশের নানাবিধ চিকিৎসার পরেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। টিস্যু বা হাড়ের সংক্রমণের কারণে একসময় তার পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন দেশের পাঁচতারকা খ্যাত একটি হাসপাতালের চিকিৎসক। অর্ণবের উদ্বিগ্ন বাবা-মা একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ২০১৮ সালে পাড়ি জমান পাশের দেশ ভারতে।
বিজ্ঞাপন
সেখানে ভেলোরে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় পা কাটার পরিবর্তে অনেকটাই সুস্থ হয়ে দেশে ফেরেন অর্ণব। এরপর প্রতি ছয় থেকে আট মাস পরপর ভেলোর ও পরবর্তী সময়ে কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি অনিরাময়যোগ্য রোগ হওয়ায় নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে রয়েছেন এই যুবক। প্রায় তিন বছর বিরতির পর মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়ন করছেন।
কাছাকাছি গল্প মাদারীপুরের প্রশান্ত দাসের। পয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রশান্তের হঠাৎ করেই সারা শরীর ফুলে যায়। যা স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রতিবন্ধকতা তৈরির পাশাপাশি পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে। স্থানীয় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে সম্ভাব্য কিডনিজনিত জটিলার কথা উল্লেখ করে পরীক্ষার পরামর্শ দেন। তবে দেশে ও বিদেশে (ভারত) থাকা আত্মীয়দের পরামর্শে প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পরীক্ষা করান। এতে তার কিডনির টিস্যুতে চর্বি জমার সমস্যা ধরা পড়ে। কিডনিতে ফ্যাট খুব একটা দেখা যায় না। তবে রেনাল সাইনাস লিপোম্যাটোসিস, অ্যাডিপোসিটি, অ্যাঙ্গিওমায়োলিপোমা অথবা লিপিড নেফ্রোসিসের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এ অবস্থায় ভারতেই চিকিৎসা গ্রহণ করেন তিনি।
আরও পড়ুন
অর্ণব ও প্রশান্তের মতো অসংখ্য বাংলাদেশি নানাবিধ রোগের চিকিৎসার জন্য ভারতসহ বিশ্বের দেশে যান। যাকে ‘হেলথ ট্যুরিজম’ বলা হয়। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণার প্রাথমিক তথ্যে মতে, বছরে ৯ থেকে ১০ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় সংখ্যাটি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দাবি রয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৬০ হাজার কোটি টাকা) খরচ করছেন বাংলাদেশিরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘চিকিৎসাসেবায় বিদেশমুখিতা: আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশিদের হেলথ ট্যুরিজমের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া দেশের তালিকায় শীর্ষ রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এই তালিকার ১০ নম্বরে আছে বাংলাদেশ।
কোথায় এবং কোন রোগের চিকিৎসায় বিদেশে যায় বাংলাদেশিরা?
‘চিকিৎসাসেবায় বিদেশমুখিতা: আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে মোট চারটি সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন হয়। এসব সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মোট রোগীদের ৫১ শতাংশ যান ভারতে। এছাড়া থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ২০ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে, ৩ শতাংশ, ২ শতাংশ করে যায় জাপান ও মালয়েশিয়ায় এবং ১ শতাংশ রোগী চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে যায়।
বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ৩২২ জন ব্যক্তির ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, চিকিৎসা নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৫০ শতাংশ শুধু রোগ নির্ণয় ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিদেশে গেছে। এছাড়া হার্টসহ নানাবিধ সার্জারির জন্য ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ, ক্যানসার বা টিউমার চিকিৎসায় ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ, দাঁতের চিকিৎসার জন্য ২ দশমিক ২০ শতাংশ ব্যক্তি বিদেশে গেছেন।
এছাড়া এক হাজার ১৯৬ জন পর্যটকের ওপর করা পরিচালিত অপর সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে হার্টের রোগীরা, যা মোট রোগীর ১২ দশমিক ২০ শতাংশ। চোখের চিকিৎসায় ১০.৫৩ শতাংশ, কিডনির সমস্যা নিয়ে ৮ শতাংশ, বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার নিয়ে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, ফ্র্যাকচার নিয়ে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, হাড়ের সমস্যায় ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ বিদেশে যায়। এছাড়া লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিস ও গাইনি সমস্যা নিয়েও রোগীরা বিদেশে যাচ্ছে।
সাধারণ অবস্থায় বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা ব্যক্তিদের ধনিক শ্রেণির মানুষ হিসেবে চিহ্নত করা হলেও এই তালিকায় রয়েছেন নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। এক হাজার ১৮১ জন পর্যটকের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি চারজন পর্যটকের একজন পেশায় ব্যবসায়ী অর্থাৎ মোট ২৫ শতাংশ। এরপর ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেসরকারি চাকরিজীবী, ১২ শতাংশ দিনমজুর, ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ সরকারি চাকরিজীবী, ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ শিক্ষক, ৫ শতাংশ চিকিৎসক রয়েছে। এ ছাড়া এ তালিকায় সাংবাদিক, পুলিশ ও শিক্ষার্থীও রয়েছেন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় রয়েছে ক্যানসার রোগীরা, যা মোট বিদেশগামী রোগীর শতকরা ২১ শতাংশ। এরপর হৃদরোগের জন্য ১৮ শতাংশ বাংলাদেশে বিদেশ যাচ্ছেন। এছাড়া প্রজনন জটিলতা, অর্থোপেডিক, গ্যাস্ট্রোঅ্যান্ট্রোলজি, লিভার, কিডনি, চোখ, কান ও স্নায়বিক চিকিৎসার জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যায় বাংলাদেশিরা।
কেন বিদেশমুখী রোগীরা?
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) বিজ্ঞানী ডা. আহমদ এহসানুর রহমানের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আইসিডিডিআর,বির একজন গবেষক হিসেবে নিজের মতামত তুলে ধরে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। এর একটি সামাজিক এবং অপরটি ক্লিনিক্যাল। সামাজিক কারণে মধ্যে মানুষের সাথে কথা বলে মোটা দাগে যে বিষয়গুলো ওঠে আসে সেগুলো হলো: দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট, চিকিৎসকরা ঠিকমতো সময় দেয় না, আমাদের রেফারেল ব্যবস্থার না থাক, মান নিয়ন্ত্রিত সেবা দেওয়া হয় না ইত্যাদি।
এই বিজ্ঞানী বলেন, এ সংক্রান্ত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের মধ্যে ৫০ শতাংশের অধিক ভারতে যায়। এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগ নির্ণয় ও রুটিন চেকআপ করার জন্য যায়। অর্থাৎ আমাদের ডায়াগনস্টিকের ওপর হয় মানুষের আস্থা নেই। অথবা আধুনিক সরঞ্জাম বা লোকবলের ঘটতি রয়েছে। আরেকটি প্রধান কারণ হার্টসংক্রান্ত নানা সমস্যা। যদিও হার্টের চিকিৎসায় বাংলাদেশ যথেষ্ট ভালো অবস্থায় রয়েছে। এরপরেও কেন মানুষ হার্টের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যায় তা একটা বড় প্রশ্ন। এর সম্ভবত ব্যাখ্যা আস্থার ঘাটতি। যদিও হার্টের কিছু চিকিৎসায় আমরা এখনো দক্ষ হয়ে উঠতে পারিনি। প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রগতির জায়গায় উন্নয়ন থেমে গেছে। মেডিকেল সেক্টরে প্রতিনিয়ত আপডেট আসছে। দশ-বারো বছর আগে আমরা যখন বলতাম হার্টের চিকিৎসায় আমরা ভালো অবস্থায় আছি, আমরা যদি যে স্থানেই আটকে থাকি বা ছোট উন্নয়ন সাধন করি তাহলে বিশ্বের থেকে আমরা পিছিয়ে পড়বো।
ডা. আহমদ এহসানুর রহমান বলেন, আমরা দেখেছি দেশে ক্যানসারের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে মানুষ ভারতে চলে যায়। তারা বলেন, সেখানে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন, যদি শনাক্ত হয় তাহলে সেখানেই চিকিৎসা নেবেন। এর কারণ হয়ত আমাদের ক্যানসারের হাসপাতালগুলোতে স্ক্রিনিং ও চিকিৎসায় খুব সুন্দর পথ-ঘাট করা নেই। রোগীদের স্ক্রিনিং থেকে চিকিৎসা পেতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেক সময় ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করলে খরচ বেশি হওয়ার পরিবর্তে কম হয়। কারণ তারা ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদন করে, যা আমরা নামে মাত্র করি। ফলে ওষুধ আমদানির খরচ চিকিৎসা খরচের সাথে যুক্ত হয়।
এছাড়া তিনি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ওয়ানস্টপ সেবা সার্ভিসের কথা উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে বিদেশ যাওয়া রোগীদের একটা বড় অংশ চোখের চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্যসেবা এ খাতে বাংলাদেশ যথেষ্ট এগিয়ে উল্লেখ করে এ বিষয়ে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান।
বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের তালিকায় চিকিৎসকরাও
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া জনগোষ্ঠীর তালিকায় রয়েছেন চিকিৎসকরাও। প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৫ শতাংশ চিকিৎসক। এ প্রসেঙ্গে জানতে চাইলে ডা. আহমদ এহসানুর রহমান বলেন, ঠিক কী কারণে চিকিৎসকরা বাইরে যাচ্ছেন সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। এক্ষেত্রে আমি আমার হাইপোথেসিস বা নিজস্ব ব্যাখ্যাটি বলতে পারি। কোনো নির্দিষ্ট রোগের ক্ষেত্রে তারা জানেন এর চিকিৎসা দেশ থেকে বাইরে ভালো। যেমন: আমাদের চিকিৎসকের ভেতর এখনো অনেক রয়েছেন, যিনি নিজের ওপেন হার্ট সার্জারিটা বাইরে করেন। বিষয়টি সব সময় আস্থার সংকট, তেমন নয়। ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ আমাদের থেকে চিকিৎসাব্যবস্থায় এগিয়ে আছে। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কেউ যদি সেটা জানেন এবং সামর্থ্য থাকে তাহলে অবশ্যই তারা বাইরে যাবেন।
এমএইচ/জেবি