রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

এক্স-রের ফিল্ম সংকটকে পুঁজি করে নিটোরের ল্যাবে রমরমা বাণিজ্য!

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৫ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

এক্স-রের ফিল্ম সংকটকে পুঁজি করে নিটোরের ল্যাবে রমরমা বাণিজ্য!
ছবি: ঢাকা মেইল

গত প্রায় ছয় মাস ধরে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল এবং পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) এক্স-রের ফিল্মের তীব্র সংকট চলছে। রোগীর দেহের বিভিন্ন অংশ ভাঙা পরীক্ষায় এই ফিল্ম ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে সেখানে আসা মানুষজন কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছেন শত শত রোগী। তবে এই সংকটকে পুঁজি করে এক্স-রে করানোর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা রমরমা বাণিজ্যে লিপ্ত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা প্রতিদিন শত শত রোগীর কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

গত বুধবার (৩ জুলাই) সরেজমিনে রোগী এবং তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে এমন ভোগান্তির চিত্র পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


সিলেট থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন আব্দুল হান্নান। পায়ের হাঁটুর উপরে তার সামান্য হাড় বেড়ে গেছে। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ভালো সেবা পেতে পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করেছেন। তিনি বলছিলেন, এক্স-রে ল্যাবে দুই ঘণ্টা আগে এসেছি। এখনো দীর্ঘ লাইন। আমার এক্স-রে হয়নি। ওইদিকে ডাক্তার বসে আছেন। এখানে সঠিক সময়ে এক্স-রে করাতে না পারলে হয়ত আজকের দিনটা মিস হবে। অবশ্য পরে তিনি বাড়তি টাকা দিয়ে এক্স-রে করান। সেটাও এই সরকারি হাসপাতালেই!

পঙ্গু হাসপাতালে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে এক্স-রের ফিল্ম সংকট চলছে। বর্তমানে এই সংকটের কারণে প্রতিদিন বেলা ১১টার মধ্যে এক্স-রে ফি'র টাকা নেওয়া বন্ধ করে দেন কাউন্টারে থাকা কর্মীরা।

হাসপাতালের কয়েকজন আনসার সদস্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, গত ছয় মাস ধরে হাসপাতালটিতে এক্স-রে ফিল্মের সংকট চলছে। প্রতিদিন এখন প্রায় এক হাজার রোগীকে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর বেশি হলে দ্রুত কাউন্টার থেকে জানানো হচ্ছে, সেদিন আর এক্স-রে পরীক্ষার ফি জামা নেওয়া হবে না। বিষয়টি নিয়ে এখন আর কারো মাথাব্যথা নেই।

রুবেল ও ইমন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ছাত্র এসেছিলেন ধানমন্ডি এলাকা থেকে। ইমনের হঠাৎ করে পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা। বন্ধুর রুবেল পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়ান। দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে যখন কাউন্টারে টাকা জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই মুহূর্তে রুবেলকে জানানো হলো, এক্স-রে ফির টাকা নেওয়া সম্ভব না। কারণ এখন এক্স-রের ফি জমা তারা ১১টা পর্যন্ত নিতে পারেন। যদিও ফিল্ম সংকটের কারণ তারা উল্লেখ করছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে সকাল আটটা থেকে ১টা পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা জমা দেওয়া যায়। এরপর দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে পরীক্ষা। ডাক্তাররা ভালোভাবে সেবাও দেন।

হাজারীবাগ থেকে এসেছিলেন সোলায়মান মিয়া। স্থানীয় সড়কে অটোরিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। গত ছয় মাস থেকে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন এই হাসপাতালটিতে। তার পায়ের অবস্থা বেশ উন্নতির দিকে। সেদিন দুপুরে নিচে থাকা বহির্বিভাগে তিনি চিকিৎসককে দেখালে পায়ের অবস্থা সর্বশেষ কী তা জানার জন্য এক্স-রে দেওয়া হয়। কিন্তু দুপুর ১২টার পর কাউন্টারে গিয়ে আর টাকা জমা দিতে পারেননি। ফলে পরদিন তাকে যেতে হয়েছে।

Nitor2

শুধু সোলেমান মিয়ার নন, এখন প্রতিদিন শত শত মানুষ পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে এক্স-রে পরীক্ষার ফি জমা দিতে পারছেন না বেলা ১১টার পর। যদিও সেটা নেওয়ার কথা একটা পর্যন্ত।

এক্স-রে ল্যাবে রমরমা ব্যবসা!

হাসপাতালটিতে গত ছয় মাস থেকে এক্স-রে ফিল্মের সংকটকে কেন্দ্র করে এই পরীক্ষায় যারা নিয়োজিত তাদের রমরমা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১০০ থেকে ২৫০ টাকা দিলে খুব সহজে অল্প সময়ে মেলে এক্স-রে পরীক্ষা। তখন আর কাউন্টারে টাকা জমা দিতে হয় না। সেই টাকা চলে যায় এক্স-রে পরীক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও কর্মীদের পকেটে। এভাবে প্রতিদিন শত শত মানুষের পরীক্ষার টাকা একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই অভিযোগ পাওয়ার পর বুধবার (৩ জুলাই) সরেজমিন এই প্রতিবেদক ১০৭ নম্বরের এক্স-রে রুমে প্রবেশ করে। দুপুরের পর গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির পশ্চিম পাশের নিচ তলায় ১০৭ নম্বর এক্স-রে রুমের ভেতরে নারী শিশু বৃদ্ধের ব্যাপক ভিড়। বাইরেও শত শত মানুষ অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তাদের কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা বাড়তি টাকা দিচ্ছেন তাদের দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করছে সেখানে থাকা দুই যুবক। একজন ল্যাব ইনচার্জ হিসেবে কাজ করছেন। আরেকজন রোগীদের পরীক্ষায় সহায়তা করছেন।

পরীক্ষা দ্রুত করিয়ে দেওয়া তাদের দায়িত্ব হলেও তারা সেটা না করে আনসারের মাধ্যমে রোগীপ্রতি নির্ধারিত ফির বাইরে ১০০ থেকে ২৫০ টাকা করে আদায় করছেন। যার পুরো টাকা ল্যাব ইনচার্জ এবং তাকে সহযোগিতাকারী ব্যক্তির পকেটে চলে যাচ্ছে। ল্যাবের ভেতরে বাড়তি টাকা নিয়ে এমন বাণিজ্য চললেও বাইরে থাকা লোকজন কেউ জানতে পারছে না বিষয়টা। ফলে অনেকে সেদিন পরীক্ষা করাতে পারেনি। কাউন্টারে টাকা জমা দিতে গিয়ে ফেরত এসেছে।

ল্যাবটিতে প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর খোঁজ নিয়ে এবং ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেল, প্রতিদিন বেলা ১১টার পর আর কোনো ফি জমা নেওয়া হয় না। এই সুযোগটিকে কাজে লাগান ল্যাবে থাকা ব্যক্তিরা। যাদের খুব জরুরি তারা ১০৭ নম্বর রুমে এসে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তখন দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা এবং বিশেষ মেরুন বা হলুদ রঙের কটি পরা ব্যক্তিরা তাদের নিয়ে যান এক্স-রে রুমে। তবে তাদের আগে বলা হয়, তিনি সহযোগিতা করবেন, এজন্য তাকে বাড়তি কিছু টাকা দিতে হবে। বিষয়টি কারো কাছে বলা যাবে না।

আরও পড়ুন

জলাতঙ্ক: যে রোগে মৃত্যু অনিবার্য

সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অন্তরায় আস্থা ও নিরাপত্তা সংকট!

কিডনি চিকিৎসার সামর্থ্য নেই ৯০ শতাংশ রোগীর

জানা গেছে, প্রতি আনসার সদস্য ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে নেন। আর ল্যাব ইনচার্জ এবং সহকারী ১০০ থেকে ২৫০ টাকা নেন। এই বিষয়টিও রুবির স্বজনদের আগে বলা হয়। যে কাগজে পরীক্ষার ফি জমা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়, সেটি ল্যাবে থাকা ব্যক্তিরা নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন।

যদিও বলা হয়, পরদিন তারা সেই কাগজ কাউন্টারের জমা দেবেন। কিন্তু এসব কাগজ আর পরবর্তী সময়ে জমা হয় না বলে জানা গেছে। এভাবেই ১০৭ নম্বর রুমে প্রতিদিন শত শত রোগীর পরীক্ষায় হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালটির ১০৭ নম্বর রুমে প্রতিদিন দুপুর ১২টার পরে গেলে মনে হবে পিকনিক জমেছে। অথচ নিয়ম হচ্ছে, এক্স-রে পরীক্ষার সময় সেই রুমে রোগী ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়া। কিন্তু ৩০ থেকে ৪০ জন রোগীর সামনেই বারবার দরজা লাগিয়ে এক্স-রে করা হচ্ছে। এর গামা রোশনি ছড়িয়ে পড়ছে উপস্থিত রোগী ও রোগীর স্বজনদের শরীরে। সেদিকে যেন কোনো খেয়াল নেই কারও।

আদাবর থেকে এসেছিলেন ব্যাংকার রাহুল (ছদ্মনাম)। তিনি ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, ‘ভাই দেখছেন, কী একটা অবস্থা। আমরা টাকা জমা দিতে গেলাম কাউন্টারে, টাকা নেওয়া হলো না। কিন্তু এখানে এসে দেখি বাড়তি টাকা দিলে পরীক্ষা করানো যাচ্ছে! আমার পেছনে মেরুদণ্ডে ব্যথা। ডাক্তার আজই পরীক্ষা করে দেখাতে বলেছেন। ভাগ্য ভালো, এক আনসার সদস্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।’

Nitor3

তখনও তিনি পরীক্ষা করতে পারেননি। পরে আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে দুপুর ১টার দিকে এক্সরের ফিল্ম নিয়ে বের হন। 

এক্স-রের ফিল্মে থাকে না কোনো কাভার!

১০৭ নম্বর রুমে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল, যাদের পরীক্ষা শেষ হচ্ছে তাদের দেওয়া হচ্ছে একটি এক্স-রে ফিল্ম। কিন্তু এই ফিল্মগুলোর সাথে হাসপাতালের লোগো সম্মিলিত একটি কাভার দেওয়ার কথা। যা অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এখানে সেটি দেখা যায়নি। রোগী বা রোগীর স্বজনরা প্রত্যেকে হাতে ব্ল্যাঙ্ক বা খালি ফিল্ম নিয়ে বের হচ্ছেন।

আসমা খাতুন নামে এক নারী তার স্বামীর পায়ের সমস্যার পরীক্ষায় এক্স-রে নিয়ে বের হওয়ার সময় কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে ফি ঠিকই আদায় করা হয়েছে। কিন্তু এই ফিল্মটা সংরক্ষণে হাসপাতাল থেকে আগে কাভার দেওয়া হতো সেটা এখন দেওয়া হচ্ছে না। এসব কথা আমরা কাকে বলবো!

আরও পড়ুন

নির্দেশনা কতটা মানছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘সবাই ডাক্তার’, বাড়াচ্ছে ঝুঁকি 

হাসপাতালের আতঙ্ক আনসার বাহিনী!

এসব বিষয়ে কথা বলতে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিচালক ডা. কাজী শামীম উজ্জামানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

তবে হাসপাতালটির পরিচালক (প্রশাসন) মাহফুজুল হক শুক্রবার (৫ জুলাই) রাতে ঢাকা মেইলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘চলতি মাস (জুলাই) পর্যন্ত এই সমস্যা চলবে। কারণ ঠিকাদারের সাথে যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী তারা এক্স-রের ফিল্ম সরবরাহ করছে।’

অন্যদিকে এক্স-রের ফিল্ম সংকটকে পুঁজি করে সংশ্লিষ্টরা বাড়তি টাকা নিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে সেটা সম্পর্কে তার জানা নেই বলে জানান এই কর্মকর্তা। বিষয়টি তিনি যাচাই করে দেখবেন বলেও জানান।

এ প্রতিবেদক নিজে সেই রুমে অবস্থান করে যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে জানালে মাহফুজুল হক বলেন, এমনটি কে করছে সেটা আমাদের জেনে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর