মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

হাসপাতালের আতঙ্ক আনসার বাহিনী!

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৩৪ এএম

শেয়ার করুন:

hospital
সম্প্রতি হৃদরোগ হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের পেটায় আনসার বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। দেশের সবচেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হৃদরোগের সরকারি হাসপাতালটিতে সারাদেশে থেকে জটিল হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে নানা বয়সী রোগীরা চিকিৎসা করাতে আসেন। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীদের ভোগান্তি ও হয়রানির অভিযোগ বহু পুরনো। সম্প্রতি হাসপাতালটিতে সেবা নিতে আসা এক রোগীর স্বজনদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে। এ ঘটনা জানার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠেছে। স্বজনদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে।

রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন আনসার সদস্যরা। তবে বাহিনীটির কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, দুর্ব্যবহার এমনকি আহত করার অভিযোগ ওঠছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার কথা থাকলেও বাহিনীটির কিছু সদস্য কমিশনে রোগী অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ার মতো অনিয়মেও জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও তাদের হাতে নাজেহাল হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: সঠিক সময়ে আসেন না চিকিৎসক, রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষা

এ অবস্থায় বাহিনীটির সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়াসহ চিকিৎসার সামগ্রিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আনসার সদস্যদের দায়িত্ব হাসপাতালে পরিবেশ রক্ষা ও চিকিৎসক, নার্স, রোগীসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু তারাই নানা অনিয়মে জড়িয়ে গেলে সেবা প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট সবাই নিরাপত্তাহীনতায় পড়বেন বলে মত তাদের। সাম্প্রতিক জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ঘটনা এটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

কী ঘটেছিল হৃদরোগ হাসপাতালে?

গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তানজিনা আক্তার নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, সিসিইউতে ভর্তি স্ত্রীর জন্য রক্ত নিয়ে যাচ্ছিলেন তার স্বামী সেলিম রেজা। তখন সিসিইউতে প্রবেশ করতে গেলে তার কাছ থেকে ঘুষ দাবি করেন কর্তব্যরত আনসার সদস্য। ইতঃপূর্বে প্রবেশের সময় তিনবার টাকা নেন ওই আনসার সদস্য। পুনরায় টাকা দিতে না চাইলে সেলিম রেজার ছেলেকে চড় দেন এবং শটগানের বাট দিয়ে আঘাতের চেষ্টা করেন। এ সময় শটগানের নল লেগে ওই আনসার সদস্যের কানের ওপরে মাথার কিছু অংশ কেটে যায়। তখন তিনি বাঁশি বাজিয়ে এবং ফোনে ক্যাম্পের সব আনসার সদস্যকে ডেকে সেলিম রেজা, তার স্কুল ও কলেজপড়ুয়া দুই ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীর বড়বোনসহ উপস্থিত সব স্বজনকে মারধর করেন। সময়মতো রক্ত দিতে না পারায় এবং মারধরের খবর শুনে হৃদরোগে সিসিইউতে মারা যান তানজিনা।


বিজ্ঞাপন


Hospital2

এ ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, টাকা না দিলে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন ব্যক্তির স্বজনদের প্রবেশ করতে দেন না আনসার সদস্যরা। তানজিনা আক্তারকে রক্ত দিতে সিসিইউতে প্রবেশ ও টাকা দিতে অস্বীকার করাকে কেন্দ্র করেই হৃদরোগে অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনার সূত্রপাত।

আরও পড়ুন: কাজে আসছে না ঢামেকের ই-টিকিটিং

তবে হৃদরোগ হাসপাতালে থাকা আনসার ইনচার্জ (পিসি) মনির হোসেন দাবি করেন, তার সদস্যরা কাউকে মারধর করেনি, উল্টো রোগীর স্বজনরাই আনসার সদস্যকে মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ১০-১৫ জন এসে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন তানজিনা আক্তারের স্বজন পরিচয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। পরে আনসার সদস্যরা বাধা দিলে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সিসিইউর গেটে থাকা আনসার সদস্যের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে আঘাত করলে ওই সদস্যের মাথা ফেটে যায়। এ ঘটনা দেখে অন্য আনসার সদস্যরা পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসেন। এতে স্বজনরা আরও উত্তেজিত হয়ে হামলা করে। পরে আনসারদের টাকা চাওয়ার নাটক সাজায়।

আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে অনসারদের বিরুদ্ধে রোগীর স্বজনদের মারধরের ঘটনা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবে এটিই নতুন কোনো ঘটনা নয়। আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। হৃদরোগের ঘটনা শুধু বিষয়টিকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাহবুবুল আলম নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠে কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রাথমিক তদন্তকালে ঢাকা মেডিকেল কর্মরত ৫৯ আনসার সদস্যকে প্রত্যাহারও করা হয়।

Hospital3

গত ৪ জুলাই রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের রোগীর স্বজন ও সাংবাদিকদের মারধরের অভিযোগে দুই আনসার সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে তাদের জোন কমান্ডারের অফিসে সংযুক্ত করা হয়। ঘটনা সূত্রে জানা যায়, মুগদা মেডিকেলের সামনে ক্যানসার আক্রান্ত এক মা তার ছেলেকে নিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে আসেন। ৪০ জনের নমুনা নেওয়ার কথা থাকলেও ৩৪ জনের নমুনা নেওয়ার পর  আনসারের মাধ্যমে সেদিনের মতো কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে আনসারদের সঙ্গে ওই রোগীর ছেলে শাওনের উত্ত্যক্ত বাক্যবিনিময় হয়। এরপর শাওনকে টেনেহিঁচড়ে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে মারধর করে। সেই ছবি ধারণ করতে চাইলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক সাংবাদিকে ওপরও চড়াও হয় আনসার সদস্যরা।

আরও পড়ুন: হাসপাতাল যেন ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসক ও স্টাফদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন আনসার সদস্যরা। এ ঘটনায় উভয়পক্ষের একাধিক ব্যক্তি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার কথা থাকলেও বাহিনীটির কিছু সদস্য কমিশনে রোগী অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ার মতো অনিয়মেও জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও তাদের হাতে নাজেহাল হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

সম্প্রতি ঢাকা মেইলের ‘টাকা দিন আনসার সদস্যদের, গাড়ি রাখুন নিশ্চিন্তে’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আনসার সদস্যদের আর্থিক অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। সরেজমিন প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, টাকার বিনিময়ে আনসার সদস্যরা রোগীর স্বজন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাকাজে আগত ব্যক্তিদের বাইক ও গাড়ি পার্কিং করতে দেন। টাকা দিতে অস্বীকার করলে হাসপাতাল এলাকায় গাড়ি প্রবেশের সুযোগও দেওয়া হয় না।

আরও পড়ুন: হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হৃদয়হীন কারবার!

এমনকি বিএসএমএমইউতে বিভিন্ন সংবাদ কাভার করতে আসা গাড়ি পার্কিংয়েও বাধা দেন আনসার সদস্যরা। যদিও প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক ভবনের সামনে অসংখ্য গাড়ি নিয়মিত পার্কিং করা থাকে। এ বিষয়ে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদের নজরে আনা হলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

হাসপাতালের সামগ্রিক পরিবেশ নষ্টের শঙ্কা

আনসারদের অনিয়ম ও সেবার পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা দুঃখজনক। একইসঙ্গে এটি চিকিৎসার সুস্থ পরিবেশ বিনষ্ট করবে। দুঃখজনকভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে কেউ এসে হাসপাতালে ভাঙচুর ও চিকিৎসক-নার্সদের মারধর করে। এটি চিকিৎসার পরিবেশ ব্যাহত করে। এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে এবং চিকিৎসার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্যই আনসারদের হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেউ যাতে আইনের বাইরে কিছু না করে সেটা দেখাই তাদের কাজ। কিন্তু আনসার বাহিনী নিজেরাই যদি অনিয়মে যুক্ত হয়, তাহলে এটি হীতে বিপরীত হবে। এটি কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।

Hospital4

আনসার সদস্যদের অনিয়মে করণীয় জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক বলেন, আনসার সদস্যদের কাছে হাসপাতাল কী চায়, সেটি তাদের জানতে হবে। তা না হলে, অন্যখানে যেভাবে ডিউটি করে এখানেও সেভাবেই করতে চাইবে। সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাসপাতালে অবশ্যই অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করলে হবে না। আনসাররা যেন অনিয়মে যুক্ত না হয়, সে জন্য নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের আচার আচরণ কেমন হবে, তারা কী কাজ করবে সেটা সেখানে উল্লেখ থাকতে হবে। হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী ও আনসার সদস্যদের যৌথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেন তাদের মধ্যে ঠিকমতো ওরিয়েন্টেশন হয়। হাসপাতালে কর্মরত বাহিনীর সদস্যদের যৌথ সুপারভিশন মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। কেননা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরাসরি আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তাই তাদের কাজ ও দায়িত্ব পালনের বিষয়ে যদি নিয়মিত যৌথ সুপারভিশনের করা হয় তাহলে সমস্যাগুলো বহুলাংশেই সমাধান হয়ে যাবে।

চাকরিতে সন্তুষ্টির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, প্রত্যেক মানুষের জব সেটিসফিকশনের প্রয়োজন রয়েছে। কেউ যদি সেখানে খুশি না থাকে তাহলে নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। কারও যদি পরিবার না চলে, তাহলে যত নীতিবাক্যই বলা হোক না কেন, তারা অনৈতিক পন্থায় উপার্জনের সুযোগ খুঁজবে। তাই এটিও নিশ্চিত করতে হবে।

এমএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর