মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বিদায় বেলায় নানা চাপে ভিসি শারফুদ্দিন!

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

বিদায় বেলায় নানা চাপে ভিসি শারফুদ্দিন!
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

দায়িত্ব পালন শেষে আগামী ২৮ মার্চ পদ ছাড়ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। প্রখ্যাত এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ ২০২১ সালের ২৯ মার্চ পরবর্তী তিন বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আগামী ২৯ মার্চ থেকে নতুন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেবেন আরেক প্রখ্যাত চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক।

দায়িত্ব পালনকালে সুপার স্পেশালইজড হাসপাতাল, জরুরি বিভাগ চালুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নতুন অনেক সেবা যুক্ত করেছেন অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ। একইসঙ্গে স্বজনপ্রীতি, নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। তবে বিদায় বেলায় এসে নতুন করে নানা চাপে পড়তে হচ্ছে বর্তমান উপাচার্যকে। এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিতে স্থায়ী করা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অধ্যাপক শারফুদ্দিনকে। এমনকি দীর্ঘদিন উপাচার্যের সবচেয়ে সমর্থক হিসেবে পরিচিত কর্মচারীদের দ্বারা অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে।


বিজ্ঞাপন


বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ

মেডিকেল শিক্ষায় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। একইসঙ্গে দেশের সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যসেবাও এই প্রতিষ্ঠানটিতে মেলে। তবে উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরেই উত্তপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে এডহকে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের স্থায়ীকরণ নিয়ে গত কয়েক দিনে চিকিৎসকদের দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৪ ও ১৬ মার্চ দুই দফা হাতাহাতির ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে।

আরও পড়ুন

চার ঘণ্টা পর অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত বিএসএমএমইউ ভিসি শারফুদ্দিন

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতাদের একাংশের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম না মেনে গত তিন বছরে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ বিভিন্ন পদে প্রায় দুই হাজার এডহকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া এসব ব্যক্তির চাকরি স্থায়ীকরণ করতে আবার নিয়ম ভাঙছেন বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ীকরণ কমিটির মতামত না নিয়ে তড়িঘড়ি করে স্থায়ীকরণের জন্য ভাইভা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।


বিজ্ঞাপন


BSMMU

অপর দিকে বর্তমান উপাচার্যের শেষ সময়ে এসে আন্দোলনে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেশ কিছু সংগঠন। গত ১৬ মার্চ সকাল ৯টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ থেকে ৫০০ কর্মচারী উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে শারফুদ্দিন আহমেদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। কর্মচারী নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন করা সংগঠনগুলোর নেতারা উপাচার্যের বিরুদ্ধে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত কারা ও কথা না রাখার অভিযোগ করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের ভিত্তিতে ১৮ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন তারা। এতে চার ঘণ্টার অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি পান উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ। যদিও এই সংগঠনগুলো সব সময় উপাচার্যের সমর্থকগোষ্ঠী হিসেবেই পরিচিত ছিল। এমনকি সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থীদের বেতন বাড়ানো আন্দোলনে উপাচার্যের পক্ষ হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগ ছিল অনেকের বিরুদ্ধে।

যা বলছে আন্দোলনকারী বিভিন্ন পক্ষ

বিএসএমএমইউর নিয়ম অনুযায়ী এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা এক বছর পর চাকরিতে নিয়মিত হবেন। এ লক্ষ্যে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও স্থায়ীকরণ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে তাদের চাকরিতে স্থায়ী করা হয়। স্থায়ীকরণ কমিটিতে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগের ডিন ও হাসপাতাল পরিচালক। তবে তা না মেনেই চাকরিতে স্থায়ী করার লক্ষ্যে ভাইভা নেওয়ার অভিযোগ শিক্ষকদের একাংশের। তাদের মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন সুমন। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী স্থায়ীকরণ হবে ভাইভা বোর্ডের প্রতিটি সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু সেটি মানছেন না বর্তমান উপাচার্য। তড়িঘড়ি করে নিজ অনুগতদের পদোন্নতি ও এডহকে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের স্থায়ী করছিলেন। এতে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন

এডহক ভিত্তিতে ২০০০ নিয়োগের তথ্য সঠিক নয়: বিএসএমএমইউ

নিয়মনীতি না মানার অভিযোগ করে ডা. জাকির হোসেন বলেন, বর্তমান উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালাতে উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, ডিনসহ বিভিন্ন পদে থাকাদের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু তিনি তা করেননি। পছন্দমতো নিয়োগ দিয়ে, এখন এদের স্থায়ী করার চেষ্টা করছেন।

এদিকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে কথা না রাখার অভিযোগ কর্মচারী নেতাদের। তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী কল্যাণ সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. নুরে আলম দিপু ঢাকা মেইলকে বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মহান জাতির জনকের নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো পূর্ণাঙ্গ কর্মচারী চাকরি নীতিমালা নেই। যার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিকভাবে অনেকেই সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছেন। এখানে ১৬তম গ্রেডের ওয়ার্ড মাস্টার থেকে প্রশাসনিক কর্মকতা হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ওয়ার্ডবয় থেকে সেকশন অফিসার পর্যন্ত হয়েছেন। বিগত তিন বছর যাবত নির্বাচিত তিনটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সকল কর্মচারী ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি নীতিমালা’ প্রণয়নের দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন নানা টালবাহানা করে কেবল কালক্ষেপণ করছে।

VC2

দিপু বলেন, বর্তমান উপাচার্যের সময়কালে সর্বশেষ সিন্ডিকেটের সভা আগামী ২০ তারিখ। এর মাধ্যমে তিনি তার সমস্ত অবৈধ কাজ বৈধ করে যাচ্ছেন। শুধু আমাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে টালবাহানা করছেন।

অভিযোগ অস্বীকার বর্তমান প্রশাসনের

নানা ঘটনায় পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক দিন যাবতই জাতীয় গণমাধ্যমগুলোর সংবাদে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। গত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া বিশৃঙ্খল পরিবেশ ও অভিযোগের বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসা এডহক ভিত্তিতে দুই হাজার চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের তথ্য মিথ্যা বলে দাবি করা হয়েছে। একইসঙ্গে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য এসব মিথ্যা অভিযোগ করছে বলেও দাবি বর্তমান প্রশাসনের।

এসব ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে যতটুকু জানি স্বাচিপের চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা মিছিল বের করে। উনাদের দাবি, যেহেতু ইতোমধ্যে নতুন উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন সুতরাং কোনো পদোন্নতি দেওয়া, স্থায়ীকরণ, সিন্ডিকেট মিটিং করতে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে বর্তমান উপাচার্য নিজেও আশ্বস্ত করেছেন।

আরও পড়ুন

বিএসএমএমইউর উপাচার্য পদে নিয়োগ পেলেন অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ

বর্তমান উপাচার্য ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা একাডেমিক কাউন্সিলের একটি সভা করছিলাম। সেখানে কিছু পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের কথা ছিল। এরমধ্যে কিছু চিকিৎসক এসে বলল এই সভা করার দরকার নেই। এর মধ্যেই বাইরে শুনি কিছু মানুষ হৈ-হুল্লোড় করছে। তারা চাচ্ছে যেহেতু আমার শেষ সময়, আমি যেন কোনো কিছু না করি। আমিও আমার শেষ সময়ে কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চাই না, তাই আমি সভাটি স্থগিত করেছি। স্থায়ীকরণে কোনো ধরনের ভাইভাও নেওয়া হচ্ছিল না। তবে একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, ফলাফল প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু নিয়ে একটি পক্ষ আন্দোলন করে সব কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। আমরা সব বন্ধ করে দিয়েছি।

কথা বলতে রাজি নন সাবেকরা

এসব বিষয়ে অতীতে দায়িত্ব শেষকালে একই ধরনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বর্তমান উপাচার্যের সঙ্গে তার যোজন যোজন ফারাক বলে জানান। তিনি বলেন, আমি একক ক্ষমতাবলে কোনো পদোন্নতি দিইনি। যাদের পদোন্নতি হয়েছে, নিয়ম মেনেই হয়েছে। যতদিন দায়িত্বে ছিলাম সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি। বর্তমান উপাচার্য প্রসঙ্গে আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। এছাড়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন নেই। সুতরাং নো কমেন্টস। 

অপর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম খান এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না এবং বর্তমানে নিজ এলাকায় রয়েছেন বলে ঢাকা মেইলকে জানান।

এমএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর