বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হাসপাতাল যেন ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৯ এএম

শেয়ার করুন:

হাসপাতাল যেন ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’
ফাইল ছবি

তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মোবাইল ফোন। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইল ফোন ছাড়া সেবা খাতের কোনো কিছুই কল্পনা করা যায় না। তবে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হাসপাতালে দেখা যায় পুরো উল্টোচিত্র। সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ হাসপাতালের গেট থেকে করিডোর, করিডোর থেকে ওয়ার্ড- যত ভেতরে যাওয়া যায় ইন্টারনেট ও সাধারণ মোবাইল নেটওয়ার্ক ততই কমতে থাকে। অথচ জরুরি প্রয়োজন ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই পরিষেবা সবচেয়ে জরুরি।

সম্প্রতি অসুস্থ মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগে আসেন রংপুরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। নিজের অজ্ঞিতা তুলে ধরে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলের ‘ওয়ার্ডে’ ইন্টারনেট তো নাই-ই, সাধারণ মোবাইল নেটওয়ার্কও ছিল না। স্বজনরা ফোন দিয়ে পায়নি। পরিচিতরা মায়ের খোঁজ নিতে সারাদিন চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি। অফিস থেকে অসংখ্যবার কল দিয়ে নম্বর বন্ধ পেয়েছে। জরুরি যোগাযোগের জন্য ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায় যেতে হতো। তবে সেখানেও সিগনাল অত্যন্ত দুর্বল।


বিজ্ঞাপন


একই চিত্র দেশের বেশিরভাগ সরকারি-বেসকারি হাসপাতালেই। রাজধানীর মিরপুরে হার্ট ফাউন্ডেশনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে হাসিব উল্লাহ নামে একজন ঢাকা মেইলকে বলেন, এই হাসপাতালে আমার চাচার বাইপাস সার্জারি হয়েছে। এই অপারেশনে দীর্ঘ সময় লাগে। এই সময় স্বজনরা বারবার মোবাইল ফোনে খোঁজখবর নেয়। কিন্তু এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ইন্টারনেট সেবা ২জি থাকে আর মোবাইলে কল করার জন্য বারবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়। তাও ভালোভাবে কথা বোঝা যায় না।

ভুক্তভোগী চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরাও

হাসপাতালের মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ে এই ভোগান্তি শুধু রোগীর স্বজনদেরই- বিষয়টি এমন নয়। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও এই ভোগান্তির শিকার। রোগীর স্বজনদের থেকে তাদের ভোগান্তিটাই বরং বেশি। কেননা রোগীর স্বজনরা একটি নির্দিষ্ট সময় হাসপাতালে অবস্থান করেন। কিন্তু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মঘণ্টার পুরো সময় হাসপাতালেই অবস্থান করতে হয়।

হাসপাতালে নেটওয়ার্কের সমস্যার কথা জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢামেক হাসপাতালের ভেতরে মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে না। মোবাইল ডাটা ও অফলাইনে কথা বলা- দুই ক্ষেত্রেই সমস্যা। সাম্প্রতিক সময়ে একটি অপারেটরের নেটওয়ার্ক কিছুটা ঠিক থাকলেও বাকিদের কোনো সার্ভিসই পাওয়া যায় না। ডাটা ব্যবহার করতে হলে হাসপাতালের নির্দিষ্ট ওয়াইফাই ব্যবহার করতে হয়। আর অফলাইনে কথা বলতে হলে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে বারান্দা বা কোনো খোলা স্থানে যেতে হয়।

কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ এ বিষয়ে পরিচালকের কাছে অভিযোগ করেনি। ওয়ার্ডে নেটওয়ার্ক থাকবে না, এটাকে সবাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে। কারো জরুরি কথা বলার প্রয়োজন হলে সে বারান্দায় গিয়ে কথা বলেন। আর হাসপাতালের স্টাফরা নির্দিষ্ট ওয়াইফাই ব্যবহার করেন।

dmc

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এ সমস্যা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বাংলালিংককে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা নেটওয়ার্ক আপগ্রেড করেছে বলে জানিয়েছে। গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক মোটামুটি ভালো ছিল, কিন্তু ইদানিং আমরা সমস্যা লক্ষ্য করছি। এ বিষয়ে কিছু অভিযোগও পেয়েছি। আশা করি শিগগিরই ঠিক হবে।

সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনসহ (বিটিআরসি) অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে কথা বলিনি।

নেটওয়ার্ক বিভ্রাটের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক বলেন, এটা আমাদের নলেজে আছে। শুধুমাত্র রোগী বা রোগীর স্বজনরাই তো মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন না, আমরা চিকিৎসকরাও ব্যবহার করি। এখন, নাই তো নাই। হয়তো মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ছিল, কোনো কারণে সেটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে সম্পূর্ণ এলাকার লোকজনই পায় না। এটা আমাদের কনসার্ন নয়।

অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা

হাসপাতালে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিভ্রাটের বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ঢাকা মেইলকে বলেন, এই সমস্যা সারাদেশেই রয়েছে। হাসপাতালকে আলাদাভাবে বিবেচনার কিছু নেই। কোথাও ভালো আছে, আবার কোথাও সমস্যা রয়েছে। ৫৪ হাজার বর্গমাইলে ১৮ কোটির বেশি মোবাইল ব্যবহার হয়। প্রত্যেকের জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করা মোবাইল ফোন অপরেটরদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। আর হাসপাতালের কেউ যদি আলাদাভাবে কিছু চায় তাহলে সেটা দেখা হবে। আমার জানা মতে, হাসপাতালের কেউ কখনও বলেনি যে, তাদের এখানে নেটওয়ার্ক খারাপ।

এ সমস্যার কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ির ভেতরে নেটওয়ার্ক পাওয়াটা এমনিতেই কঠিন। নেটওয়ার্ক দেয়ালেও বাধা পায়। এটি সহজ কাজ না। যেমন, জাতীয় সংসদ ভবনে নেটওয়ার্ক পেতে সমস্যা হয়। কারণ আমরা যদি কোনো জায়গায় টাওয়ার বসাতে না পারি অথবা আলাদা কোনো ডিভাইস বসাতে না পারি, তাহলে তো নেটওয়ার্ক পেতে সমস্যা হবেই। এ অবস্থায় হাসপাতালগুলোকেই উদ্যোগটা নিতে হবে। যারা নেটওয়ার্ক চায় তাদের বলতে হবে, আমাদের হাসপাতালের ভেতর ডিভাইস বসিয়ে দেন। এই বিষয়টি নিয়ে কেউ কখনও কোনো কিছু বলেনি। কোনো হাসপাতাল কখনও বলেনি যে আমাকে নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে জ্যামার লাগানো থাকে।

মানোন্নয়নে তদারকি ও গবেষণা প্রয়োজন

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আপনি হাসপাতালের বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন! হাসপাতাল তো অনেক দূরের বিষয়, আমাদের সচিবালয়, সংসদ ভবনের মতো স্থানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। মানুষ যেন রুমে বসে সব ধরনের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা পেতে পারে সে বিষয়ে কমিশন কিংবা মন্ত্রণালয় কেউই এখন পর্যন্ত কোনো সুপারিশ করেনি। এমনকি ঘরে বসে নেটওয়ার্ক না পাওয়ার কারণও সংশ্লিষ্টরা ঠিকমতো শনাক্ত করতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের মোবাইল সার্ভিস দেওয়ার সঙ্গে ১২১টি প্রতিষ্ঠান জড়িত। এর মধ্যে আমরা শুধু মোবাইল অপারেটরকে চিনি, বাকি ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে আমি চিনিই না। এদের সম্পর্কে আমাদের ধার‍ণাই নেই। এতগুলো প্রতিষ্ঠানের ইকোসিস্টেম তৈরির জন্য বিটিআরসি যে নীতিমালা তৈরি করেছে তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা চাপ দিলে টাওয়ারের মাইক্রোওয়েভ বাড়ানো হয়। কিন্তু এতে জনগণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও অপরেটরের বাড়তি খরচের বিষয় রয়েছে। পাশাপাশি এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। অনেক সময় ট্রাফিক বেশি হওয়ায় পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এর কারণ অপরেটররা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বিবেচনা করে সক্ষমতা নির্ধারণ করে। কিন্তু ওই এলাকায় ট্রাফিক কেমন হতে পারে তা চিহ্নিত করা হয় না। এটি যারা নির্ধারণ করে থাকেন, তারা সঠিকভাবে তা করতে পারছেন না। কোন এলাকায় কত সংখ্যক মানুষ থাকে বা ব্যবহারকারী থাকতে পারে সেটি বিবেচনায় নিয়ে সার্ভারের সক্ষমতা নির্ধারণ করা উচিত। আর এজন্য প্রয়োজন যথাযথ সার্ভে।

নেটওয়ার্ক সমস্যা সমাধানের বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রুমের ভেতর, ভবনের নিচতলা কিংবা বহুতল ভবনে নিরবচ্ছিন্ন সেবা পেতে হলে এই ভবনগুলোকে কানেক্টিভিটির আওতায় আনতে হবে। প্রতিটি ভবনে অপারেটরের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে কিছু আইনগত জটিলতা আছে। তারা যেন কাজ করতে পারে সেই ছাড়পত্র নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিটিআরসি কি শুধু লাইসেন্স দেবে, নাকি জনগণ কতটা সেবা কতটা পাচ্ছে সেটাও দেখবে- এ বিষয়ে তাদের আরও চিন্তা ও গবেষণা করা দরকার।

এমএইচ/জেএম/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর