বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

পথেঘাটে কামড়াচ্ছে কুকুর, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভিড়

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০২ নভেম্বর ২০২২, ১১:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

পথেঘাটে কামড়াচ্ছে কুকুর, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভিড়

রাজধানীর মাদারটেকের বাসিন্দা রহিমা বেগম। মধ্যবয়সী এই নারী তার দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে এসেছেন। লক্ষ্য এগারো-বারো বছর বয়সী মেয়েকে রেবিসের টিকা দেওয়া। কান্নারত মেয়েকে টিকা দেওয়া শেষে একপ্রকার কোলে করেই বের হচ্ছেন ওই নারী। সাথে আট থেকে দশ বছর বয়সী ছেলে।

দুই শিশুকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, গতরাতে শিশু দুটি বাড়ির পাশে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। আসার পথে কুকর দেখে ভয় পেয়ে দুই ভাই-বোন দৌড় দেয়। তখনই কুকুরটি তার মেয়ের পায়ে চারটি জায়গায় কামড় বসায়। এই অবস্থায় তাকে নিয়ে তিনি সকাল-সকালই হাসপাতালে এসেছেন। আউটডোরে চিকিৎসক দেখানোর পর মেয়েটিকে রেবিস প্রতিরোধক টিকার তিন ডোজ দিয়ে বাড়ি ফিরছেন। আগামী ৪ নভেম্বর টিকার পরবর্তী ডোজ নেওয়ার তারিখ দিয়েছে, সেদিন আবার আসবেন।


বিজ্ঞাপন


এ সময় বাচ্চাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কত দিন বলছি, কুত্তা দেখে দৌড়াবি না।’

Special Newsরহিমা বেগমের মতো আরও অসংখ্য মানুষ কুকুর-বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ের চিকিৎসায় হাসপাতালে এসেছেন। বেশিরভাগই ড্রেসিং ও টিকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তাদের সবার চোখেই এক অজানা আতঙ্ক। মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) সরেজমিনে হাসপাতালটি ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।

এমনই একজন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা, পঞ্চাশোর্ধ্ব জামাল উদ্দিন। সকালে কাজে যাওয়ার পথে কয়েকটা কুকুরের মাঝে পড়ে যান তিনি। এ সময় একটি কুকুর তার পায়ে কামড় বসায়। নিরাপত্তার স্বার্থে তাৎক্ষণিক বন্ধুকে নিয়ে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে এসেছেন। লক্ষ্য চিকিৎসক দেখিয়ে টিকা ও ওষুধ নেওয়া।

হাসপাতালের আউটডোরে রোগীর চাপের বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বরতরা জানান, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বহির্বিভাগ সেবা দেওয়া হয়। দুই শিফটে এই সেবা পরিচালিত হয়। এই সময়ের মধ্যে প্রতিদিন হাজারের অধিক রোগী বহির্বিভাগে আসেন। এর মধ্যে অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ জন কুকুর-বিড়ালে কামড়জনিত সমস্যা নিয়ে আসেন। এছাড়া হাম-রুবেলাসহ অন্যান্য রোগীরাও আসেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কুকুরে কামড়ের রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যেখানে দিনে সর্বোচ্চ ২০০ এর মতো রোগী আসতো, এখন এক শিফটেই এই পরিমাণ রোগী আসছে। যেমন আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত মোট ২১০ জন প্রাণীর কামড়ের সমস্যা নিয়ে এসেছে।


বিজ্ঞাপন


Special Newsকুকুরের কামড়ের টিকার বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে উল্লেখ করে তারা জানান, অনেক রোগী সন্দেহের বশেও হাসপাতালে আসছেন। চিকিৎসকরা প্রয়োজন বুঝে তাদের টিকা দেন। এটি একটি পজেটিভ দিক।

এমনই এক রোগীর স্বজনের সাথে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। আজিমপুরের বাসিন্দা গোপাল নামে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই শিশু খেলতে গিয়ে একটি মৃত প্রাণীর দাঁতের উপর বসে পড়ে। এতে তার ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং রক্তপাত ঘটে। এ অবস্থায় এটি কোন প্রাণীর দাঁত তা নিশ্চিত হতে পারেননি শিশুটির পরিবারের সদস্যরা। ফলে স্থানীয় ফার্মেসি দোকানির পরামর্শে শিশুটিকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তারা। ব্যাগে দাঁত দেখিয়ে তার মায়ের প্রশ্ন, ‘এটি তো গরুর দাঁত তাই না? বাচ্চাটা ইনজেকশন দিতে ভয় পাচ্ছে। না দিলে কি সমস্যা হবে? আর প্রাণীটাও তো মৃত ছিল।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কুকুরের কামড়জনিত রোগীর সংখ্যাটি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। ঋতুভেদেও এর তারতম্য দেখা যায়। সাধারণত গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ রোগী কুকুরের কামড়জনিত সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। তবে ইদানীং তা কিছুটা বেড়েছে। এখন প্রতিদিন পুরাতন ও নতুন মিলিয়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ রোগী আসছে।’

Special Newsহাসপাতালের সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কুকুর, বিড়াল ও অন্যান্য প্রাণীয় কামড়ের জন্য টিকা দেওয়াটা আসলে আমাদের একটি অতিরিক্ত সেবা। আমাদের মূল কার্যক্রম যেমন, ধনুষ্টংকার, এইচআইভি-এইডস, হাম, চিকেন পক্স, করোনা, রেবিস রোগীদের সেবা দেওয়া। এসব রোগীকে আমরা নিয়মিত বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে সেবা দিচ্ছি। পাশাপাশি বিভিন্ন টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’

প্রাণীর কামড় নিয়ে ভর্তির বিষয়ে জানাতে চাইলে সংক্রামক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘কুকুর বা অন্য প্রাণীর কামড়ে রোগীদের ভর্তি হওয়ার রেশিওটা অনেক কম। বেশিরভাগ রোগীই প্রাথমিক চিকিৎসা ও টিকা নিয়ে বাড়ি চলে যায়। শুধু ক্যাটাগরি-৩ কামড়ের রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হয়। অর্থাৎ যাদের কামড়ের ক্ষত বেশি বা জটিল তারাই শুধু ভর্তি হয়। তাদের ড্রেসিং, ইঞ্জেকশন বা ভ্যাকসিন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়। অর্থাৎ যাদের মেজর ইন্জুরি রয়েছে তাদেরকেই ভর্তি নেওয়া হয়। আর এই সংখ্যাটা অনেক কম।’

জলাতঙ্ক নিয়ে ভর্তি রোগীর বিষয়ে ডা. মিজান বলেন, ‘বাংলাদেশের একমাত্র সেন্টার হিসেবে সারাদেশ থেকেই জলাতঙ্ক রোগী আমাদের এখানে আসে। রেবিস বা জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যু শতভাগ। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো রোগীর এটি সারভাইব করার নজির নেই। তবে কিছু কিছু রোগী আসে যারা অসম্পূর্ণ ভ্যাকসিন পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অনেক রোগী প্যারালাইসিস অবস্থায় বেঁচে থাকে।’

এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের এখানে রোগী এলে আমরা তাকে সিমটমিক চিকিৎসা দিই। এসব রোগীর প্রথম লক্ষণ হাইড্রোফোবিয়া, এতে রোগী পানি দেখলে ভয় পায়। পানি গিলতে পারে না। পরবর্তী সময়ে রোগীর ফটোফোবিয়া দেখা দেয়, তারা আলো সহ্য করতে পারে না। সর্বশেষ ধাপ এরোফোবিয় বা বাতাস সহ্য করতে না পারা। এ অবস্থায় রোগী বাতাসও সহ্য করতে পারে না। রোগীর কাছে পাখা দিয়ে বাতাস করলেও সে পেনিকড হয়ে যায়। এরোফোবিয়া ডেভেলপ করার পর সেই রোগীকে আর বাঁচানো যায় না। সাধারণত ২৪-৭২ ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।’

এমএইচ/জেবি/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর