বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

আদানি সাম্রাজ্যে পতনের সুর!

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৭:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

আদানি সাম্রাজ্যে পতনের সুর!
ফাইল ছবি

ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির করপোরেট সাম্রাজ্যে হঠাৎ পতনের সুর উঠেছে। বৃহস্পতিবারের পর আজ শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) সকালে এই পতনের গতি আরও বেড়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের তথ্যমতে, সবশেষ দুই সেশনে পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বাজারমূল্য হারিয়েছে আদানি গ্রুপ।

সম্প্রতি এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে গৌতম আদানি ও তার সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি এবং প্রতারণার অভিযোগ তোলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চ। তাদের ওই প্রতিবেদনের জেরে এশিয়ার শীর্ষ ধনীর ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে ব্লুমবার্গ।


বিজ্ঞাপন


তার মূল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের প্রতি আস্থা হারানোয় বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে ২৫০ কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। হিনডেনবার্গের সব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে সংস্থাটি। গত বৃহস্পতিবার বন্ডহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছে তারা এবং শুক্রবার অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত যুক্তি উপস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তা সত্ত্বেও আদানি গ্রুপের ওপর বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসে ফাটল স্পষ্ট।

আরও পড়ুন: ভারতের গৌতম আদানি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী 

শুক্রবার আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দর ১৯ শতাংশের বেশি কমে তিন হাজার ২৭৬ রুপির নিচে নেমেছে। তাছাড়া আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড এবং আদানি টোটাল গ্যাসের মতো কিছু সহযোগী সংস্থা দৈনিক ২০ শতাংশ পতনের সীমা স্পর্শ করেছে।

গ্লোবাল সিআইও অফিসের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার গ্যারি ডুগান বলেন, ‘ইস্যুটি ভারতীয় করপোরেট খাতের কেন্দ্রে আঘাত করেছে, যেখানে বেশ কয়েকটি পরিবার-নিয়ন্ত্রিত সংগঠনের আধিপত্য রয়েছে। স্বভাবগতভাবেই তারা অস্বচ্ছ। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের করপোরেট গভর্নেন্সের বিষয়গুলোতে আস্থা রাখতে হবে।’


বিজ্ঞাপন


adani2

আদানির সম্পদ

সাম্প্রতিক পতনের আগে গত কয়েক বছর গৌতম আদানির জন্য ছিল শুধুই উত্থানের গল্প। ২০২২ সালে এশিয়ার সর্বোচ্চ মুনাফা লগ্নিকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। গত পাঁচ বছরের উত্থানে ইলন মাস্কের টেসলা ইনকরপোরেশনকেও পেছনে ফেলেছে আদানি এন্টারপ্রাইজ। ধীরে ধীরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় নিজের অবস্থান পাকা করেছেন গৌতম আদানি।

এমনকি, গত বছরের সেপ্টেম্বরে কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছিলেন ভারতীয় এ ধনকুবের। ওই সময়ে আদানি ও তার পরিবার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন: বিশ্বের শীর্ষ ধনী পাবে কি ভারত, কত পেছনে আদানি?

কিন্তু সাম্প্রতিক পতনের ধাক্কায় ১০ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে আদানির সম্পদ। বৃহস্পতিবার দুপুরে ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্সে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল নয় হাজার ৭০০ কোটি ডলার, যা গত বুধবারের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম।

আদানি গ্রুপের বিষয়ে দুই বছর তদন্তের পর গত ২৪ জানুয়ারি গুরুতর নানা অভিযোগের বিশদ বিবরণসহ একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিনডেনবার্গ রিসার্চ। এর প্রতিক্রিয়ায় আদানি গ্রুপ বলেছে, তারা হিনডেনবার্গের বিরুদ্ধে ‘অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, গবেষণাবিহীন’ প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেবে।

জবাবে হিনডেনবার্গ অবশ্য বলেছে, তাদের প্রতিবেদন পুরোপুরি সঠিক। এর বিরুদ্ধে যেকোনো আইনি পদক্ষেপ হবে অযৌক্তিক।

মামলার প্রস্তুতি

আদানি গ্রুপ এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিকে একহাত নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। আদানি গ্রুপ বলছে, হিনডেনবার্গের রিপোর্ট “বিদ্বেষমূলক” এবং ভুল তথ্যে ভরা। তারা বলেছে, মার্কিন এই কোম্পানির বিরুদ্ধে তারা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করার কথা বিবেচনা করছে। আদানি গ্রুপ ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। ভোগ্যপণ্য ছাড়াও তাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ জ্বালানি, বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দর এবং অবকাঠামো নির্মাণের মতো বড় বড় খাতে বিস্তৃত।

আরও পড়ুন: ফিলিস্তিনের বন্দর ভারতের আদানির কাছে বিক্রি ইসরায়েলের

ফোর্বস সাময়িকীর মতে, আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানি এখন এশিয়ার এক নম্বর ধনী এবং বিশ্বের ধনীদের তালিকায় তার অবস্থান চার নম্বরে। আদানি গ্রুপ দাবি করেছে, তারা সব ধরনের আইন অনুসরণ করে ব্যবসা করে। গ্রুপের প্রধান আইন কর্মকর্তা যতিন জালুনধোয়ালা বলেছেন, “(হিনডেনবার্গের) এই রিপোর্ট প্রকাশের পর ভারতের শেয়ার বাজারে যে টালমাটাল অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এর ফলে ভারতীয় নাগরিকরা অনাকাঙ্ক্ষিত মানসিক চাপে পড়েছেন।“  

জালুনধোয়ালা অভিযোগ করেছেন, আদানি গ্রুপের শেয়ারের দরপতনের অশুভ উদ্দেশ্য নিয়েই এই রিপোর্টে “প্রমাণ ছাড়া” বিভিন্ন তথ্য এবং অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, হিনডেনবার্গ তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই এ কাজ করেছে। তবে বৃহস্পতিবার হিনডেনবার্গ তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, যেসব গুরুতর বিষয় তাদের রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে, সে বিষয়ে আদানি গ্রুপ কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়নি। হিনডেনবার্গ বলেছে, তাদের রিপোর্ট সঠিক এবং আদানি গ্রুপ মামলা করতে চাইলে তারা মোকাবেলা করবে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

আদানি গ্রুপকে নিয়ে জালিয়াতির এসব অভিযোগে ওঠার পর ভারতে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বিরোধী দলগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে গৌতম আদানি ব্যবসায় অনেক অনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। 

adani3

শিব সেনা দলের নেতা এবং পার্লামেন্ট সদস্য প্রিয়ংকা চতুর্বেদী টুইট করেছেন, “বিস্তারিত গবেষণা রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশ হওয়ার পর সরকারের উচিৎ এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করা।“ দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিবিদ কে. টি. রামারাও দাবি করেছেন, আদানি গ্রুপের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড তদন্ত করতে হবে। 

তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতের শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি তেমনটা করবে সে সম্ভাবনা এখন নেই বললেই চলে।

“ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড কেবল তখনই ব্যবস্থা নেয় যখন কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিরুদ্ধে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাঠানো হয়। কিন্তু আদানির ব্যাপারে তেমনটি এখনও হয়নি,” বলেন ভারতের শেয়ার বাজার বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনগভার্ন রিসার্চের প্রধান শ্রীরাম সুব্রামনিয়াম। ভারতের শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বিবিসি যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পায়নি।

আরও পড়ুন: মার্চে আসছে আদানির বিদ্যুৎ, কেন্দ্র পরিদর্শনে প্রতিমন্ত্রী

শুক্রবার বাজারে ২৪০ কোটি ডলার মূল্যের শেয়ার ছাড়ার কথা ছিলো আদানি গ্রুপের। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, অনেক বিনিয়োগকারী এখন সতর্ক অবস্থানে থাকতে পারেন। তবে মার্কিন এই গবেষণা রিপোর্টের প্রভাব শুধু আদানি গ্রুপ নয়, তার বাইরেও গিয়ে পড়তে পারে। 

ব্লুমবার্গের কলামিস্ট অ্যান্ডি মুখার্জি বলেছেন,“আদানি ছাড়াও সামগ্রিকভাবে ভারতের শেয়ার বাজারের বিশ্বস্ততা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।“ তার মতে, এর অন্যতম কারণ কারণ হলো ভারতের শেয়ার বাজার এখনও একদিকে আর্থিক ব্যবস্থার বৈশ্বিকীকরণ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ভেতরে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে। মুখার্জি লিখেছেন, “জঞ্জাল দূর করার জন্য ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি রাস্তায় মানুষের ক্ষোভের জন্য অপেক্ষা করবে?”

এইচআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর