শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘কোমর ভাঙা’ এক্সিম ব্যাংকের দাঁড়িয়ে থাকার ভান!

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

bank
নাজুক অবস্থায় রয়েছে এক্সিম ব্যাংক। ছবি গ্রাফিক্স: ঢাকা মেইল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৫ বছরের শাসনকালে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয় ব্যাংক খাতে। এতে কয়েকটি ব্যাংক ভেতরে ভেতরে ফোঁকলা হয়ে যায়। অনেকটা ‘কোমর ভাঙা’ অবস্থায় কোনো রকম টিকে আছে সেই ব্যাংকগুলো। এই ক্যাটাগরির ব্যাংকের অন্যতম ইসলামি ধারার এক্সিম ব্যাংক। এতদিন ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার’ মতো ব্যাংকটির লুটপাটের প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হলেও পটপরিবর্তনের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে প্রকৃত চিত্র। ব্যাংকটির অবস্থা এতটাই নাজুক যে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার তারল্য সহযোগিতা নেওয়ার পরও সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষণ দৃশ্যমান হচ্ছে না।

ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংকপাড়ায় ‘শেখ হাসিনার অর্থ যোগানদাতা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা ১৭ বছর হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল থাকেন এবং লম্বা সময় ধরে ব্যাংকগুলোতে তিনি অঘোষিত কর্তৃত্ব চালান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আলোচিত এই শিল্পপতি গ্রেফতার হয়েছেন। আর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিকটাত্মীয় নজরুল ইসলাম স্বপন।


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শেষে সম্প্রতি ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স পাস করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবশেষে গভর্নর ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের ঘোষণা দিলে বাকিদের আপত্তি না থাকলেও রহস্যজনকভাবে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন দ্বিমত পোষণ করে নিজেদের ‘ভালো ব্যাংক’ বলে দাবি করেন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে বাস্তবতা ভিন্ন দেখা যায়। এমনকি (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ) একিউআর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ব্যাংকটির বিভিন্ন সূচকে তথ্য গোপনের বিষয়টিও উঠে আসে।

আরও পড়ুন

সিটি ব্যাংক পরিচালকের বন্ধকী সম্পদ নিলামে তুলছে ব্যাংক এশিয়া

রাঘববোয়াল-চুনোপুটি মিলেমিশে লুটেছে ইউনিয়ন ব্যাংক

তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংক তাদের মোট খেলাপির পরিমাণ দেখায় ৩ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। অথচ একই সময়ের একিউআর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ। এমনকি এই খেলাপি ডিসেম্বর নাগাদ ৫১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলেও মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।


বিজ্ঞাপন


Bank2
দেশজুড়ে শাখা চালু করতে পারেনি ব্যাংকটি। ছবি: সংগৃহীত

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক্সিম ব্যাংকে বর্তমানে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৯১০ কোটি টাকা। অভ্যুত্থানের পর ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা নিয়েছে। ১৫৫ শাখার ব্যাংকটি বিগত বছরে একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০৯ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির শেয়ারদর কমে ৫ টাকা ৩০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে চালু হলেও ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী এর কার্যক্রম চালু করতে পারেনি। সারাদেশে মাত্র ১৫৫টি শাখা নিয়ে কার্যক্রম চালানো ব্যাংকটির গ্রাহক সংখ্যা মাত্র ১৫ লাখের কাছাকাছি। ব্যাংকটির অধিকাংশ শাখা শহরকেন্দ্রিক হওয়াতে প্রান্তিক মানুষ সেবা পায় না, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা সম্প্রসারণ নীতি ও শরিয়াহ নীতি-পরিপন্থী। এক্সিম ব্যাংক করপোরেট গ্রাহকনির্ভর হওয়ায় সাধারণ লোকজন এ ব্যাংক থেকে ব্যাংকিং সুবিধা খুব কমই পায়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাংকটি এই নিয়ম অনুসরণ করে আসছে। নারী উদ্যোক্তা, এসএমই ও কৃষি খাতে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে।

এ বিষয়ে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপনের ফোন নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করা হলেও রিপ্লাই দেননি। তবে সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এক্সিম ব্যাংকের যতটা ক্ষতি গত সরকারের সময়ে হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে গত ১০ মাসে। কয়েক দফায় বলা হয়েছে, এক্সিম ব্যাংক দুর্বল, এক্সিম ব্যাংক একীভূত হবে। এর ফলে দফায় দফায় আমাদের ব্যাংকের গ্রাহকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যাতে ব্যাংকের তারল্য–সংকটে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়। এছাড়া বিদেশিদের দিয়ে ঋণের মান পরীক্ষায় প্রায় অর্ধেক ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছে, যা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর।

আরও পড়ুন

টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকে সহায়তা, সুফল পাচ্ছে না গ্রাহক

ফেরত আসছে না ঋণ, ব্যাংকের পর সংকটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও

ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ মতে, কোনো তফসিলি ব্যাংক অকার্যকর হয়ে গেলে বা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যাংককে রেজল্যুশন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ব্যাংক নীতিমালায় কোনো ব্যাংকে ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ গ্রহণযোগ্য নয় এবং খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশের উপরে হলে বাধ্যতামূলকভাবে ওই ব্যাংককে অবসায়ন করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক্সিম ব্যাংকের বিষয়ে বলেন, আমরা তো জানি তাদের অবস্থা কেমন। তারা যদি মার্জারে যেতে না চায় তবে আমাদের কাছ থেকে যেসব টাকা নিয়েছে তা ফেরত দিক, তাদের লোকশান প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করুক। অনেক খেলাপি হয়েছে, সেগুলো রিকোভার করুক।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এক্সিম ব্যাংক বলছে আমাদের অবস্থা ভালো, আমরা মার্জারে আসব না। আমরা বলছি খারাপ, অবশ্যই মার্জারে আসতে হবে। কার কার্পেটের নিচে কত ময়লা ছিল তা আমরা জানি। আমরা ফরেনসিক করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’

Bank3
‘শেখ হাসিনার অর্থ যোগানদাতা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান। ছবি: সংগৃহীত

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এক্সিম ব্যাংকের এখন যে অবস্থা তাতে নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মার্জারের মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংক মিলে একটি শক্তিশালী ইসলামি ব্যাংক গঠন করা হলে গ্রাহক ও আমানতকারী সবাই নিরাপদ হবে। একীভূতকরণের ফলে ব্যাংকগুলোতে বিদ্যমান ১৫ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী, ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫০০ এজেন্ট আউটলেট, ১ হাজারের বেশি এটিএম বুথ ও প্রায় ১ কোটি গ্রাহক নিয়ে বিশাল আকারে চালু হবে নতুন ইসলামি ব্যাংক। যার মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আসবে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ঋণের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ হবে স্বাবলম্বী এবং স্বনির্ভর। অগ্রসর হবে দেশ ও দেশের অর্থনীতি।

আরও পড়ুন

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় শরিয়াহ ব্যাংকগুলো, ফিরছে আস্থা

সবল ব্যাংকের পোয়াবারো, ‘শনির দশা’ দুর্বল ব্যাংকে

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এই একীভূতকরণ উদ্যোগটি সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা ও খেলাপি ঋণে জর্জরিত ইসলামি ব্যাংকগুলোর পৃথকভাবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এখন তাদের একত্রিত করে একটি সুসংগঠিত কাঠামোর অধীনে আনলে ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা বাড়বে। দ্রুত দুর্বল ব্যাংকসমূহ একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। যেসব ব্যাংক এক্ষেত্রে অসহযোগিতা করবে তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর