দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো কৃষির ওপর নির্ভর করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। দিন দিন এই খাতে তৈরি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা। সময়ের সাথে বাড়ছে ঋণের চাহিদা। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও বরাবরই কৃষিঋণ বিতরণে অনীহা দেখা যায় ব্যাংকগুলোর। গত এক মাসের ব্যবধানে সামান্য বাড়লেও অর্থবছরের ব্যবধানে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে এক হাজার কোটিরও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। আগামীকাল মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) নতুন অর্থবছরের কৃষিঋণ বিতরণের নীতিমালা ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিজ্ঞাপন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ মে মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৩২ হাজার ২১১ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করে। যেখানে তার আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকগুলো বিতরণ করা হয়েছিল ৩৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। সে হিসেবে অর্থবছরের ব্যবধানে এই খাতে ঋণ বিতিরণ কম হয়েছে ১ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
কৃষিঋণ হলো কৃষিকাজের জন্য ঋণ নেওয়া, যা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায়। এই ঋণ সাধারণত বীজ, সার, কীটনাশক কেনা, সেচব্যবস্থা স্থাপন এবং অন্যান্য কৃষি বিষয়ক সরঞ্জামাদি কেনার জন্য ব্যবহৃত হয়।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা ও বৃষ্টির কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। এরপরেও তারা তাদের ঋণ পরিশোধ অব্যাহত রেখেছেন। অফের এই সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণ কমলেও বেড়েছে আদায়। শত প্রতিকূলতার মধ্যে ঋণের টাকা ফেরত দিয়েছেন কৃষকরা।
বিজ্ঞাপন
তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ আদায় করেছে ৩৩ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। যেখানে তার আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকগুলোর আদায় ছিল ৩২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে অর্থবছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা বেশি আদায় করেছে।
আরও পড়ুন
ব্যাংক ঋণের সিংহভাগ ধনীদের দখলে, প্রান্তিকরা পেছনেই
ফেরত আসছে না ঋণ, ব্যাংকের পর সংকটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করেছে। এই নীতিমালায়, মোট ৭,২০০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১ শতাংশ অর্থাৎ ৭২ কোটি টাকা বিশেষ/অগ্রাধিকার ফসলের (ডাল, তৈলবীজ, মসলা ও ভুট্টা) জন্য রেয়াতি সুদে ঋণ বিতরণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে মাসের ব্যবধানে কিছুটা বেড়েছে ঋণ বিতরণ।
তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে ব্যাংকগুলোর কৃষিখাতে ঋণ বিতরণ ছিল ৩ হাজার ২৩৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আর পরের মাস মে’তে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১১১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কৃষিঋণ বিতরণ বেড়েছে ৮৭২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। একই সময়ে বছরের ব্যবধানেও ঋণ বিতরণ বেড়েছে ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণের মধ্যে ন্যূনতম ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করতে হয়। কোনো ব্যাংক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়। অপরদিকে কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এ জন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ। এছাড়া কৃষিঋণের কত অংশ কোন খাতে দিতে হবে, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
গত অর্থবছরের কৃষি ঋণ নীতিমালায় বলা হয়, ভবনের ছাদে বিভিন্ন কৃষি কাজ করা একটি নতুন ধারণা। বর্তমানে শহরাঞ্চলে যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত বাড়ির ছাদে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ফুল, ফল ও শাক-সবজির যে বাগান গড়ে তোলা হয় তা ছাদবাগান হিসেবে পরিচিত।
এদিকে, আগামীকাল ১২ আগস্ট নতুন অর্থবছরের জন্য কৃষিঋণ বিতরণের নীতিমালা ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এবারের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে প্রায় ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যদিও প্রতি বছর লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে কৃষকের হাতে সেই অর্থ কতটা পৌঁছায়, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় ব্যাংকগুলো কৃষিঋণের নামে অন্য খাতে ঋণ বিতরণ করে থাকে। আবার জটিল কাগজপত্র, দীর্ঘসূত্রতা এবং দালাল চক্রের কারণে কৃষকের পক্ষে সরাসরি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন
খেলাপি ঋণ আড়ালে অবলোপনের কালো ছায়া!
‘লুটপাট’ কমলেও ব্যাংক মালিকদের ‘পেটেই’ ঋণের পৌনে দুই লাখ কোটি
বিশেষ করে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নিজস্ব গ্রামীণ নেটওয়ার্ক না থাকায় তারা এনজিওদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করে, যেখান থেকে কৃষকরা উচ্চ সুদের চাপে পড়েন। ফলে সরকারি সহায়তার সুফল তারা পুরোপুরি পান না। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই কৃষিঋণ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে চলে যায়, যারা কৃষকের নাম ব্যবহার করে সুবিধা নেন। এতে প্রকৃত কৃষকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এবং কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।
কৃষিঋণ বিতরণ জোরদার করতে আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, বরাবরের মতোই কৃষিঋণ বা এসএমইর মতো ছোট ছোট যেসব ঋণ রয়েছে সেগুলোর রিকোভারি ভালো। প্রকৃতি কৃষক বা উদ্যোক্তা কখনো ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয় না। এক্ষেত্রে কৃষি ঋণ বিতরণ ও তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। আমরা মনে করি যেহেতু তাদের রিকোভারি সবকিছুই ভালো সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় এই খাতে গুরুত্ব বেশি দেওয়া উচিত।
টিএই/জেবি

