- ব্যাংক খাতের অবলোপনকৃত ঋণ ৮১৮৬৩ কোটি টাকা
- ২১ বছরে খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ৫৪ ব্যাংক
- সবচেয়ে বেশি ঋণ অবলোপন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে
খেলাপি ঋণের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ অবলোপনের পরিমাণ। এতে আরও ঝুঁকি বাড়ছে ব্যাংক খাতে। ফুলে-ফেঁপে আরও মোটাতাজা হচ্ছে লুটেরা গোষ্ঠী। যুগ-যুগ ধরে সাধারণ মানুষকেই দিতে হচ্ছে লুটপাটের খেসারত।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতে পুঞ্জিভূত অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। আর এই খাতের ঋণের স্থিতি ৬৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ অবলোপনের এই প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে, যার ফলে ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র দিন দিন আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৪টি ব্যাংক গত ২১ বছরে খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ যদি দীর্ঘদিন মন্দমানের অবস্থায় থাকে এবং আদায়ের সম্ভাবনা না থাকে, তবে সেটিকে ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিট থেকে সরিয়ে অন্য একটি লেজারে রাখা যায়। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় ঋণ অবলোপন বা ‘রাইট অফ’। ২০০৩ সাল থেকে এই ব্যবস্থা চালু হয়। তবে ঋণ অবলোপনের আগে অবশ্যই অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে হয় এবং ওই ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মার্চ পর্যন্ত ২৫ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৫৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা, বিদেশি ব্যাংকগুলো ২ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ৬১৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘ঋণ অবলোপন ধীরে ধীরে আরও বাড়বে। এসব টাকা আদায়ের কোনো আশা নেই। ব্যাংকগুলো মূলত এই টাকাগুলো লিখে বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে।’
বিজ্ঞাপন
তার মতে, ব্যাংকের খাতায় যেসব ঋণ দেখানো হয় না, যেমন: অবলোপনকৃত ঋণ বা কনসোর্টিয়াম ঋণে অপর অংশগ্রহণকারী ব্যাংকের হিসাব, সেগুলোও প্রকৃত খেলাপি হিসাবেই গণ্য হওয়া উচিত। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ সাত লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ব্যাংকাররা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার শিথিলতার কারণে ঋণ অবলোপন বাড়ছে। আগে কোনো ঋণ অবলোপন করতে হলে কমপক্ষে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হতো। ২০১৯ সালে এই সময়সীমা কমিয়ে তিন বছর করা হয়। আর সর্বশেষ গাইডলাইনে বলা হয়েছে, দুই বছর ধরে খেলাপি ও লোকসানে থাকা ঋণ এখন অবলোপনের অনুমতি পায়। এর ফলে ব্যাংকগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি ঋণ রাইট-অফ করতে পারছে।
নতুন নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, পাঁচ লাখ টাকার নিচের খেলাপি ঋণ অবলোপনের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করার প্রয়োজন নেই। আগে এই সীমা ছিল দুই লাখ টাকা। এছাড়া, কোনো ঋণগ্রহীতা মারা গেলে তার নামে থাকা খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও মামলা করার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে এসব ঋণ অবলোপন করতে পারছে। তবে আংশিক কোনো ঋণ অবলোপন করা যাবে না বলেও নীতিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করতেই অনেক ব্যাংক এখন রাইট অফ কৌশল বেশি ব্যবহার করছে। এর ফলে মূল ব্যালেন্স শিটে খেলাপি ঋণ কম দেখানো গেলেও ব্যাংকের মোট দায় কিন্তু কমে না। বরং এসব অবলোপনকৃত ঋণ আদায়যোগ্য নয় বলে ধরে নেওয়া হয় এবং সেগুলোর আদায় সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের শীর্ষ ১০টি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ অবলোপন করেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক একাই অবলোপন করেছে আট হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক (৫ হাজার ৬২৭ কোটি), জনতা ব্যাংক (৫ হাজার ১২৬ কোটি) এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (২ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা)। বেসরকারি খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবলোপন করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক (৩ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা)। এরপর রয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (৩ হাজার ১৯৭ কোটি), প্রাইম ব্যাংক (৩ হাজার ১৮৫ কোটি), সিটি ব্যাংক (৩ হাজার ১৬৫ কোটি), ব্র্যাক ব্যাংক (২ হাজার ৯৬৩ কোটি) এবং ব্যাংক এশিয়া (২ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা)।
এই তালিকার বাইরেও আরও কয়েকটি ব্যাংক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ অবলোপন করেছে। যেমন, পূবালী ব্যাংক ২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, উত্তরা ব্যাংক ২ হাজার ৪৪৬ কোটি, এবি ব্যাংক ২ হাজার ৩০৫ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ২ হাজার ১৫৪ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক ২ হাজার ১৪৫ কোটি, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ২ হাজার ৯৭ কোটি, ওয়ান ব্যাংক ২ হাজার ৭২ কোটি এবং ইস্টার্ন ব্যাংক ২ হাজার ১৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার মতে, বড় অনিয়ম বা প্রতারণার মাধ্যমে দেওয়া যেসব ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই, সেগুলোই মূলত অবলোপন করা হয়। এর ফলে দায়ীদের চিহ্নিত না করে দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়। এসব ঋণ যদি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো আদায় করা সম্ভব হতো। অবলোপনের নামে যে খেলাপি ঋণ চাপা দেওয়া হচ্ছে, তা ব্যাংক খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ঋণ অবলোপনের মতো ব্যবস্থার অপব্যবহার বন্ধ করে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা দরকার। একইসঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা গেলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত আরও গভীর সংকটে পড়বে।
টিএই/জেবি

