- রফতানি প্রবাহে আসবে বড় পরিবর্তন
- বাণিজ্য সম্পর্ক হবে আরও গভীর
- ব্যবসা ও বিনিয়োগে ফেলবে ইতিবাচক প্রভাব
- বাড়বে রফতানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে উচ্চপর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিগত সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য আহ্বান জানানো হলেও ওয়াশিংটনের তেমন আগ্রহ ছিল না। তবে এবার বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যুক্তরাষ্ট্র এফটিএ স্বাক্ষরে রাজি হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে রফতানি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে উন্মোচিত হবে নতুন দিগন্ত। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
বিজ্ঞাপন
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য আগে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তখন তারা আমলে নেয়নি। এবার তারা বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়েছে। এটি বাংলাদেশের রফতানি খাতে একটি মাইলফলক অর্জন হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, এফটিএ বিষয়ে কাজ করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। এতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) আয়েশা আক্তারকে প্রধান করা হয়। গত ১২ মে গঠন করা কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে খসড়া প্রণয়ন করে বাণিজ্য সচিবের কাছে দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে যুক্তরাষ্টের আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার বিষয়ে গত মাসে বাংলাদেশের একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তাব করা হয়। এতে রাজি হয়ে বাংলাদেশের কাছে চুক্তির খসড়া চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতর।
বিজ্ঞাপন
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান শুল্ক কাঠামোয় বড় বৈষম্য রয়েছে, এতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যে গড় শুল্ক হার মাত্র ৬.১ শতাংশ। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে কাঁচা তুলা ও স্ক্র্যাপ লোহা। এ দুটি পণ্যে শুল্ক হার যথাক্রমে ০ শতাংশ ও ১ শতাংশ।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাকের গড় আমদানি শুল্ক ১৫-১৬%। এফটিএ হলে এই শুল্ক হ্রাস পাবে বা বাতিল হবে, ফলে বাংলাদেশের পোশাক প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানি বাজার। শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলে নতুন ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং রফতানি রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। বাড়তি চাহিদা পূরণে টেক্সটাইল ও সুতা উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তবে এর মধ্যেও রয়েছে চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শ্রম মান মেনে চলার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, কর্মপরিবেশ ও ন্যূনতম মজুরির প্রশ্নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি ও গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার প্রবণতা বাড়াতে হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হওয়া দেশের কৃষি খাতের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে। কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্ভাবনাময়, কিন্তু বর্তমানে সীমিতভাবে ব্যবহৃত বাজার। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমে গেলে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের উৎপাদিত আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, ড্রাগন ফল, আলু, চা, মসলা, ফুল, শুঁটকি, মাছ ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরার মধ্যে জনপ্রিয়। এফটিএ কার্যকর হলে এসব পণ্যে শুল্ক হ্রাস বা বিলুপ্ত হবে, ফলে রফতানি বহুগুণে বাড়বে।
ফ্রোজেন ফুড, প্যাকেটজাত মসলা, হালাল মাংস, শুকনা ফলমূল, রেডি-টু-ইট খাবার ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এফটিএ সুবিধা পেলে এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি ঝুড়িতে যুক্ত হতে পারে।
এফটিএ এর আওতায় কৃষি যন্ত্রপাতি, হাইব্রিড বীজ, স্মার্ট ইরিগেশন এবং কৃষিভিত্তিক আইওটি প্রযুক্তি সহজ শর্তে আমদানি করা সম্ভব হবে। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে ও কৃষক উপকৃত হবেন।
এগ্রোটেক ও ফুড প্রসেসিং খাতে স্টার্টআপদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও বাজার উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এতে উদ্যোক্তাদের নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য নিরাপত্তা নীতিমালা অত্যন্ত কঠোর। কৃষিপণ্য রফথানিতে মাইক্রোবায়োলজিক্যাল টেস্ট, কীটনাশক অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা, বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের রফতানিকারকদের এসব মান পূরণে প্রস্তুতি নিতে হবে।
দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্য রফতানির জন্য বাংলাদেশে কোল্ড চেইন অবকাঠামো এখনো অপর্যাপ্ত। বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে কোল্ড স্টোরেজ, বিশেষ কার্গো সুবিধা এবং সময়মত শিপমেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রফতানিতে শুল্ক কমলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা নতুন সুযোগ পাবে। যুক্তরাষ্ট্রে আউটসোর্সিং পরিষেবার চাহিদা বেশি। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ও ফ্রিল্যান্সাররা এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে। মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে শাখা খোলায় আগ্রহী হতে পারে, যা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াবে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশি তরুণদের জন্য প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।
মার্কিন বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, আইটি সেবা ইত্যাদি খাতে বড় সুযোগ তৈরি হবে। রফতানির পরিমাণ বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়বে। দেশীয় শিল্পের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের বাজারে মার্কিন পণ্যের প্রবেশ সহজ হবে। কম খরচে উৎপাদনের সুবিধা নিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উপস্থিতি শক্তিশালী হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য এফটিএ একটি ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিতে পারে, বিশেষত পোশাক ও প্রযুক্তি খাতে। বাংলাদেশ যদি প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কার ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, তাহলে এই চুক্তির মাধ্যমে তিন খাতেই রফতানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বড় উল্লম্ফন ঘটবে। তবে চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে সময়োপযোগী কৌশল, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় ও বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অগ্রগতি। এই ধরনের আলোচনা দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও গভীর করতে পারে এবং উভয় দেশের ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে তাদের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ।
এফটিএ স্বাক্ষর হলে কী কী সুবিধা বা লাভ হবে বাংলাদেশের- এমন প্রশ্নের জবাবে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আগে-পরে মিলিয়ে ৫২% শুল্ক আরোপ করেছে। এর ফলে আমাদের ওপর যে যে সমস্যা হতো আমরা এই চুক্তি হলে কতটুকু রিকোভারি করতে পারবো সেটিই আমাদের জন্য সুযোগ বা লাভ। অন্যাথায় যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক সাময়িক স্থগিতাদেশ শেষ হলে ৫২ শতাংশ শুল্কের কবলে পড়বে আমাদের রফতানি খাত। ফলে তৈরি পোশাক খাতে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়বো। ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে এখাতে। উৎপাদন ও শ্রমিক নিয়েও একটা সংকটের পড়তে হতে পারে।’
এই বিশ্লেষক বলেন, ‘এফটিএ এর মাধ্যমে মূলত দুই দেশই লাভবান হবে। এতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে ফেলার সুযোগ পাবে। এফটিএ একটি পজিটিভ সাইন। যেহেতু দুই দেশ এটিকে পজিটিভলি (ইতিবাচকভাবে) দেখছে আশা করা যায় ভালো কিছু হবে। আমরা এটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।’
এমআর/জেবি