- শিল্পখাতে দৈনিক অতিরিক্ত ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা কাগুজে বাঘ
- শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, কমছে রফতানি আদেশ
- রফতানি আয় কিছুটা বাড়লেও শিল্পোদ্যোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ
- বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্পের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে
- আসন্ন ঈদুল আজহায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা
তীব্র জ্বালানি সংকটের মুখে পড়েছে উৎপাদনমুখী শিল্পখাত। ফলে বৈদেশিক রফতানি আদেশ সময়মতো পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞাপন
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি দ্রুত এই সংকটের সমাধান না হয়, তাহলে দেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হুমকির মুখে পড়বে। রফতানি কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও সংকুচিত হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এদিকে শিল্প খাতের সংকট মোকাবেলায় সম্প্রতি দৈনিক অতিরিক্ত ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা। বাস্তবে এমন ঘোষণা কাগুজে বাঘ। সরকারি ঘোষণার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রতিশ্রুত গ্যাসের সামান্য অংশই মিলছে, যার ফলে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই গ্যাস সংকটে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্পের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আসন্ন ঈদুল আজহায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়েও তৈরি হয়েছে গভীর শঙ্কা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে এ খাতে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে। তবে গত বছরের তুলনায় বেড়েছে রফতানি আয়।
বিজ্ঞাপন
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ২৬৪ কোটি ডলার। গেল অর্থবছরে একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৬৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে এ খাতের রফতানি আয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। তবে রফতানি আয় বাড়লেও শিল্পোদ্যোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকার একটি মাঝারি আকারের তৈরি পোশাক কারখানা গত ৬ মাসে গ্যাস সরবরাহের অনিয়মে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদনশক্তি হারিয়েছে। ফলে, মাসিক উৎপাদন ৫ লাখ ইউনিট থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৫ লাখ ইউনিটে এবং ক্রেতার জরুরি শিপমেন্টে জরিমানা দিতে হয়েছে।
নেক্সাস গ্রুপের কর্মকর্তা শাহরিয়া বলেন, আমরা প্রতিশ্রুত গ্যাস পাচ্ছি না। যদি প্রতিশ্রুত গ্যাস টুকুও পাওয়া যেত তাহলে উৎপাদনে একটা ব্যালেন্স (ভারসাম্য) করা যেত।
আরও পড়তে পারেন:
জ্বালানি চাহিদা মেটাতে ৫৮৪ কোটি টাকার এলএনজি কিনবে সরকার
অপর এক শিল্পকারখানার মালিক জানান, বিদ্যুৎ আর গ্যাস সমস্যার কারণে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন বন্ধ। আমাদের অপচয় বাড়ছে। এই খরচগুলোকে আমাদের রিকভার করে দেবে। কিন্তু কীভাবে করবো তা জানা নেই।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়া রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। তারা সরকারের কাছে জ্বালানি খাতে জরুরি হস্তক্ষেপ ও পরিকল্পনা দাবি করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় সহস্রাধিক কারখানা গ্যাস সংকটে ধুঁকছে। আল-মুসলিম পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপক মোসলেমুদ্দিন জানান, কারখানায় ১৫ পিএসআই চাপের গ্যাস প্রয়োজন হলেও ১ জানুয়ারি থেকে তা ২-৩ পিএসআইয়ে নেমে এসেছে, ফলে ড্রায়ার মেশিন চালানো যাচ্ছে না, শ্রমিকরা অলস সময় পার করছেন। গত এপ্রিলে সংকট বাড়ে বলে তিনি জানান।
এদিকে গাজীপুর জেলার দুই হাজারের অধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানেও রয়েছে গ্যাস সংকট। একটি কারখানার শ্রমিক আবুল হোসেন বলেন, আমরা প্রতিশ্রুত গ্যাস পাচ্ছি না। ফলে ডিজেল ব্যবহারে প্রতিদিন বাড়তি ৩০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে মালিকের।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
রফতানিমুখী শিল্পে সরাসরি নিয়োজিত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। এর অধিকাংশ নারী। তাদের কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও অস্থায়ী বন্ধের ফলে বেকারত্বের আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে।
উৎপাদন কমে গেলে রফতানি আয় কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে মুদ্রার স্থিতিশীলতায়। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রফতানি আয় কমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকীর্ণ হবে, মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়তে পারেন:
আপাতত গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াবে না সরকার
ব্যবসায়ীর বলছেন, রফতানিমুখী শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি সরবরাহ না হলে সামনের দিনের রফতানি-লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অবাস্তব হয়ে যাবে, এবং বিপুল কাজের সুযোগ হারাবে দেশের শ্রমিক সমাজ। এখনই সময়—সরকার ও বেসরকারি অংশীদারদের দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের, যাতে আবারও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়।
এলএনজি আমদানি করে শিল্পে গ্যাস সরবরাহের দাবি
শিল্পকারখানার চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানির দাবি জানিয়েছে শিল্পমালিকরা। কিংবা বিকল্প এলপিজির মাধ্যমেও তাদের চাহিদার জোগান দেওয়ার কথা বলছে তারা। সম্প্রতি শিল্পক্ষেত্রে গ্যাস ও জ্বালানির সংকট নিরসনে এলএনজি আমদানি করে টেক্সটাইল শিল্পে সরবরাহের দাবি জানিয়েছে দি ইনস্টিটিউশন অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড টেকনোলজিস্টস (আইটিইটি)।
সংগঠনটি জানায়, শিল্পক্ষেত্রে গ্যাস ও জ্বালানির তীব্র সংকটের ফলে টেক্সটাইল শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় পোশাক রপ্তানিতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এজন্য পেট্রোবাংলাকে আসন্ন বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়াসহ গ্যাসের মূল্য ২০২৩ সালের আগের মূল্যের অবস্থায় নিয়ে পুনঃমূল্য নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করে।
পেট্রোবাংলার দেওয়া সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, গত ৬ মে দেশে মোট গ্যাস সরবরাহ ছিল ২৭২ কোটি ঘনফুট, যার মধ্যে শিল্প ও আবাসিক খাত পায় ১৪৯ কোটি ঘনফুট। গত, ১২ মে মোট সরবরাহ কমে দাঁড়ায় ২৭০ কোটি ঘনফুটে, যেখানে শিল্প ও আবাসিক খাত পায় ১৬০ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ, মোট সরবরাহ কমেছে এবং শিল্পখাতে বৃদ্ধি সামান্যই।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, রমজানের তুলনায় বর্তমানে গ্যাসের মোট সরবরাহ প্রায় ১৪ কোটি ঘনফুট কমেছে। এছাড়া, অতিরিক্ত এলএনজি কার্গো চলতি মাসের শেষের দিকে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানও জানিয়েছেন, রাতারাতি গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতেও বেশি গ্যাস দিতে হচ্ছে। বাড়তি এলএনজি কার্গো কেনার অর্থ জোগাড় হয়েছে এবং ২১ বা ২২ মের মধ্যে কার্গোটি দেশে পৌঁছালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
নিট গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, গ্যাস সরবরাহ তেমন বাড়েনি, ভোগান্তি আগের মতোই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি ঘনফুটের বিপরীতে শিল্পখাত পাচ্ছে মাত্র চার থেকে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস।
টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য শিল্প কারখানা সচল রাখার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর। তিনি বলেন, অর্থনীতিকে টেকসই করতে প্রয়োজনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়িয়ে কারখানার চাকা সচল রাখতে হবে।
রফতানিমুখী শিল্পখাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে অবিলম্বে জ্বালানি সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায়, সামনের দিনে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
এমআর/এএস