* চারটি জাহাজ ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা
* ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে পাঁচ কিস্তিতে
* নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে আমদানি-রফতানিতে নতুন দ্বার খুলবে
* পণ্য বহনে কার্গো বিমানের তুলনায় খরচ ও সময় বাঁচবে
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ছেদ পড়ে। ভূ-রাজনীতিতেও আসে বড় পরিবর্তন। এই সুযোগে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় পাকাপোক্ত করছে। পাশাপাশি বেইজিং বলেছে, তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেবে। চীনা ঋণের অর্থে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য কেনা হবে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ।
বিজ্ঞাপন
শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে নানা দরকষাকষি ও দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে যায় চীনের অর্থায়নে জাহাজ কেনার প্রকল্প। তবে এবার ইউনূস সরকারকে পূর্ণ সহায়তা দিতে প্রস্তুত বেইজিং। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অনন্য দূরদর্শিতায় এবার পণ্যবাহী সামুদ্রিক জাহাজের স্বপ্নপূরণ হতে যাচ্ছে। যার ফলে বিশ্ববাণিজ্য ক্ষেত্রে নতুন দ্বার খুলবে। আমদানি-রফতানিতে সাশ্রয় হবে সময় ও অর্থ।
চীন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে নানা ইস্যুতে কাজ করতে চায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনার জন্য অর্থায়নের আশ্বাস দিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে দুটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাঙ্কার এবং দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার।
জানা গেছে, চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ২ শতাংশ সুদে ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড হিসাবে ২০ বছর ধরা হয়েছে ঋণের মেয়াদ। অর্ডার দেওয়ার পর আনুমানিক ৩২ থেকে ৩৪ মাসের মধ্যে জাহাজগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হতে পারে। নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক খাতে এক নতুন সম্ভাবনা যুক্ত হতে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চীনের সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন অফিসিয়ালি আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। চীনের সঙ্গে আমাদের প্রধানত আমদানির সম্পর্ক এবং এগুলো আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ আমাদের অনেক রফতানি সেই আমদানি পণ্যগুলোর ওপর নির্ভরশীল।
বিজ্ঞাপন
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা চীন সফর করেন। এতে চীনের নির্বাহী ভাইস-প্রিমিয়ার ডিং শুয়েশিয়াং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আয়োজন করা হয়। এতে নির্বাহী ভাইস-প্রিমিয়ার বলেন, মংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ এবং দাশেরকান্দি পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে।
তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিপিং করপোরেশনের জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনার জন্য চীনা অর্থায়নের আশ্বাস দেন।
পাশাপাশি দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়েও একমত হয়েছে।
ডিং অধ্যাপক ইউনূসকে বলেন, প্রেসিডেন্ট সি জিন পিং আপনার সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। তিনি আরও বলেন, চীন আশা করে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধি ও উন্নতি লাভ করবে।
এসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণের সুদহার ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১-২ শতাংশ করার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈঠকে ডিং শুয়েশিয়াং বলেন, বেইজিং ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা সম্প্রসারিত করবে। অর্থাৎ ঢাকা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে উন্নীত হওয়ার দুই বছর পরও এই সুবিধা বহাল থাকবে। তিনি আরও বলেন, বেইজিং ঢাকার সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনায় আগ্রহী।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে চার জাহাজ কেনার চুক্তি হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চীনের সঙ্গে এই ঋণ নিয়ে আলোচনা শুরু করে বিএসসি। তখন ৮০ হাজার ডিডব্লিউটি ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি মাদার বাল্ক জাহাজ ও ১ লাখ ১৪ হাজার ডিডব্লিউটির তিনটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংক কেনার কথা ছিল। পরে আড়াই বছর ধরে এ নিয়ে দর-কষাকষি চলে। কিন্তু তত দিনে ডলারের দাম বেড়ে যায়। এছাড়া জাহাজ তৈরির প্রধান উপকরণ লোহাসহ যাবতীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পায়। যে কারণে চীনা কর্তৃপক্ষ ছয়টি জাহাজ দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। তাই বাংলাদেশ চারটি জাহাজ কিনতে রাজি হয়। এরই মধ্যে আবারও থেমে যায় প্রকল্পের কাজ। বন্ধ হয়ে যায় অর্থছাড়ের বিষয়। সম্প্রতি ড. ইউনূসের কৌশলী তাগিদে আবারও বিষয়টি সামনে আসে। এবং দ্রুতই অর্থছাড়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিবে বলে জানিয়েছে বেইজিং। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সফলতা।
এদিকে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে এসব জাহাজ কেনার চুক্তির অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। চীনা জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে চারটি জাহাজের প্রতিটিতে বাজারদরের চেয়ে প্রায় এক কোটি ডলার বেশি দেওয়ার জন্য স্থির করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করবে।
প্রতিটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকারের (আফরাম্যাক্স) দাম পড়ছে ৭ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতিটি জাহাজ ১ লাখ ১৪ হাজার ডিডব্লিউটি ক্ষমতাসম্পন্ন। অন্যদিকে প্রতিটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজের (প্যানাম্যাক্স) দাম পড়ছে ৪ কোটি ৪ লাখ ডলার। এ দুটি জাহাজের প্রতিটি ৮০ হাজার ডিডব্লিউটি ক্ষমতাসম্পন্ন। সব মিলিয়ে চারটি জাহাজের জন্য ব্যয় হবে ২৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। এর পুরোটাই চীন সরকার ঋণ দিচ্ছে। ২০২৬ সাল নাগাদ জাহাজগুলো হাতে পাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) সূত্রে জানা গেছে, সব মিলিয়ে চারটি জাহাজ কিনতে দেশি মুদ্রায় খরচ হবে ২ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। পাঁচ কিস্তিতে এই অর্থ পরিশোধ করা হবে। ইআরডি ও বিএসসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, চারটি জাহাজ কেনায় সব মিলিয়ে ৪ কোটি ডলার বেশি দাম দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমান বাজারমূল্যে দেশের প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)।
প্রকল্পে যেসব বিষয় রয়েছে
চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রায় আড়াই বছর দর-কষাকষির পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়। এর মধ্যে চীন সরকারের ঋণ ২ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। জানা গেছে, এই ঋণ পরিশোধের সময় ২০ বছর। এর মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। সব মিলিয়ে সুদের হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিএসসির সূত্রে জানা যায়, বিএসসির বহরে এখন পর্যন্ত ৪৪টি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চীন থেকে ২০১৮ সালে এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার অর্জন ও এমটি বাংলার অগ্রগতি এবং ২০১৯ সালে এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা ও এমটি বাংলার অগ্রদূত যুক্ত হয়েছে বহরে। ১৯৮৬ সালে ডেনমার্কের তৈরি করা এমটি বাংলার সৌরভ বিএসসির বহরে যুক্ত হয় ১৫ জুন ১৯৮৭ সালে। আর ১৯৮৭ সালের তৈরি করা এমটি বাংলার জ্যোতি বহরে যুক্ত হয় একই বছরের ১৫ মে। এই দুটি জাহাজের পর যুক্ত হয়েছে ১৯৮৮ সালে এমভি দূত, ১৯৮৯ সালে এমভি বাংলার মুখ ও এমভি বাংলার শিখা এবং ২০১৮ সালে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি। এর মধ্যে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কমিশনিং বন্ধ হয়ে যায় ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধির’। এজন্য বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে সংস্থাটি। তবে বাকি তিনটি জাহাজ স্বাভাবিক নিয়মে বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ নামে দুটি লাইটার জাহাজ, বহির্নোঙরের মাদারভ্যাসেল থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারির ডলফিন জেটিতে তেল আনয়নের কাজ করত। দুটি জাহাজই সম্প্রতি হওয়া অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া সক্রিয় রয়েছে পাঁচটি।
এদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন। সম্প্রতি তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অনেক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ আছে। বিনিয়োগগুলো মূলত ঋণ আকারে। তার মধ্যে কিছু প্রকল্প চলমান।
তিনি আরও বলেন, দাফতরিকভাবে চীন আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। চীনের সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় ও গভীর করার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
এমআর/এফএ