টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ওপর। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম যেন জনসাধারণের হাতের নাগালে আসে সেই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যেকোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতি কমানোর তাগিদ দিয়েছেন সরকারপ্রধান। আর প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা পেয়ে তৎপর হয়েছে উঠেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলো। রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজারে লাগাম টানতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে তারা।
রমজানে কিছু পণ্যের চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। সেটাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রায় প্রতি বছরই সাধারণ মানুষের পকেট কাটে। এবার যেন সেই সুযোগ না পায় সেজন্য আগেভাগেই সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যায় এমন আট পণ্যের এলসিতে নগদ জমা বা মার্জিনের হার ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পণ্য হলো- ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুর। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে শূন্য মার্জিনেও এসব পণ্যের এলসি খোলা যাবে। বুধবার (১৭ জানুয়ারি) এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই সুবিধার আওতায় ঋণপত্র খোলা যাবে।
বিজ্ঞাপন
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ওই নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আসন্ন পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যগুলোর আমদানি সহজ করার মাধ্যমে মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা ও প্রয়োজনীয় সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুর এর আমদানি ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত নগদ মার্জিনের হার ব্যাংকার-গ্রাহকের সম্পর্কের ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হলো। অভ্যন্তরীণ বাজারে এসব নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ সুবিধা বলবৎ থাকবে। দেশের বাজারে উল্লিখিত পণ্যগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানি ঋণপত্র স্থাপনে অগ্রাধিকার দিতেও পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দায়িত্ব নেওয়ার পরই নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। আর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, দেশে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৪১ শতাংশ হয়েছে। এটা গত সাত মাসে সর্বনিম্ন। এই সময়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ। নভেম্বরে কমে হয় ৯.৪৯ শতাংশ। গত এপ্রিলে এটি ছিল ৯.২৪ শতাংশ। কিন্তু মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৯৪ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যমতে, ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ, আগের মাসে যা ছিল ১০.৭৬ শতাংশ। কিন্তু চালের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতি যে সামান্য কমে স্থিতিশীল হয়েছে তা কতটা ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এদিকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালের দাম কমাতে মজুদদারদের চার দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন বুধবার। একটি মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী জানিয়েছেন, এই সময়ের মধ্যে চালের দাম না কমলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে চাল আমদানি করে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বৃহস্পতিবার থেকে আট বিভাগে অভিযান চালানোর কথাও বলেন মন্ত্রী।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। সেখানে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। যদিও এটা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সাসেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও এতে স্বস্তির কিছু নেই। আশঙ্কার বিষয় হলো, চালের দাম কোনো কারণ ছাড়াই বাড়তে শুরু করেছে। আর চাল মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। সামনে রোজা৷ এই সময়ে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে, বিশেষ করে৷ আমদানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেয় প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। নিম্নবিত্ত মানুষ খাদ্যপণ্যসহ যেসব পণ্য কেনে, তার দাম বেশি। ফলে তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি।’
বাজার মনিটরিং ছাড়াও এখন অর্থনেতিক সংস্কারগুলো দ্রুত শুরু করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। বলেন, এখানে মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব আছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের একটা সংকট ছিল। এখন নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নিয়েছে। তারা কতটা পারেন তা দেখার বিষয়।
এ ব্যাপারে নতুন দায়িত্ব পাওয়া বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা খাদ্য উৎপাদন এবং আমদানি মনিটরিং করছি। এজন্য অর্থ, বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য চার মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছি। প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, কোথাও যাতে কোনো সংকট সৃষ্টি না হয় তা আমরা দেখছি। রমজান নয়, তার আগেই ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামবে। ভোক্তা অধিদফতর আরও সক্রিয় হচ্ছে। আমরা এবার আরও গভীরে যেতে চাই। খাদ্য মজুদ যাতে ঠিক থাকে তার সব ব্যবস্থা করা হবে।
নতুন দায়িত্ব নেওয়া মন্ত্রীরা সবাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নতুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, সিন্ডিকেটকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আইনগত কাঠামোর মধ্যে এদের একটা ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এদের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক ক্যাম্পেইনও তৈরি করতে হবে। সিন্ডিকেটের ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স। এটি কোন জায়গায় কীভাবে হয় সেটি চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেবি