ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের খবর দেশের মানুষের জন্য নতুন নয়। গেল কয়েক বছরে একাধিকবার ঘটেছে এমন ঘটনা। দিন তিনেক আগে, অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর পেঁয়াজের বাজারে হঠাৎ দেখা দেয় অস্থিরতা। দেশি-বিদেশি পেঁয়াজ বিক্রি হতে থাকে সাধারণের তুলনায় তিন-চারগুণ বেশি দামে। সকাল-দুপুরে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ সন্ধ্যায় কেজি প্রতি বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৪০ টাকায়।
২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছরই এই সময়ে এমন অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় পেঁয়াজের বাজারে। সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয় ভারত। এরপর দেশের বাজারে ক্রমেই বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। নভেম্বর-ডিসেম্বরে পেঁয়াজের দাম ছাড়ায় ২৫০ টাকা। একপর্যায়ে ভারত থেকে আবারও আমদানি শুরু হলে কমতে থাকে তা।
বিজ্ঞাপন
তবে শুধুমাত্র ‘রফতানি বন্ধ’কে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মানতে নারাজ ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের পরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তার অভিযোগ— কালোবাজারি একটি চক্র বাজার অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। যদিও পেঁয়াজ গুদামজাত ও অবৈধভাবে মজুদ করার অভিযোগে গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ী-আড়তদারদের জরিমানা করেছে সংস্থাটি।
বাজার বিশ্লেষক ও পেঁয়াজ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছরের এই নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের রফতানি বন্ধ করার সুযোগকে কাজে লাগায় পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের একটি অংশ।
আরও পড়ুন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে নতুন পেঁয়াজ না ওঠা আর পুরনো পেঁয়াজের সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পেঁয়াজ মজুত করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে অস্থিতিশীল বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছর একই সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছু পদক্ষেপ নেয়। অভিযান চালায় বিভিন্ন এলাকায়। এতে সাময়িকভাবে কিছুটা দাম কমলেও খুব একটা পরিবর্তন আসে না সার্বিক পরিস্থিতির।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন— প্রতি বছর একই সমস্যার উদ্ভব হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এর স্থায়ী কোনো সমাধান হয় না।
কেন ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা?
বাৎসরিক চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ হয় দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে। বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় ৫-৬ লাখ টন পেঁয়াজ। যার অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। এছাড়া মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক ও চীন থেকে অল্প পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
আরও পড়ুন
গোকুল কৃষ্ণ মানিক একজন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক। ঢাকার শ্যাম বাজারের এই ব্যবসায়ী জানান, ভারত থেকে পেঁয়াজ আনা সহজ। সড়কপথে আনা যায়। এতে খরচও কম পড়ে। এ কারণেই পেঁয়াজ আমদানির জন্য ভারতকে বেছে নেয় অধিকাংশ ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসে স্থলপথে, ট্রাক দিয়ে। কিন্তু সেই পেঁয়াজ যদি মিসর বা তুরস্ক থেকে আনি তাহলে আনতে হয় জাহাজে। তখন খরচও বেড়ে যায় বেশ কয়েকগুণ। তাছাড়া অনেকদিন জাহাজে থাকারয় পেঁয়াজ নষ্টও হয় বেশি পরিমাণ। এজন্যই পেঁয়াজ রফতানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা দিলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দামে বড় ধরনের তারতম্য দেখা দেয়।
প্রতিবছর দাম বাড়ে কেন?
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘মসলা গবেষণা কেন্দ্র’। দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি। ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার এখানকার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টাতে সাধারণত পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে, যে সুযোগ কাজে লাগিয়ে মজুতদাররা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে।
তিনি বলেন, দেশীয় উৎপাদনের বড় অংশ হয় বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে। সেসময় মোট দেশীয় উৎপাদনের ৮০ ভাগ পেঁয়াজ কৃষক ঘরে তোলে। তাই পেঁয়াজের দাম মার্চ-এপ্রিলের দিকে সবচেয়ে কম থাকে। মার্চ-এপ্রিলে হওয়া এই পেঁয়াজই দেশে উৎপাদিত প্রধান পেঁয়াজ। এটি ছাড়াও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হওয়া মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও জুন-জুলাইয়ে অল্প পরিমাণ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ হয়ে থাকে।
ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, সেপ্টেম্বরের পর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজের ফলন হওয়ার আগের এই সময়টায় বাজারে পেঁয়াজের কিছুটা ঘাটতি থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে দেখা যায় অধিকাংশ কৃষকের কাছে পেঁয়াজের মজুত থাকে না। কিন্তু মজুতদারদের কাছে পেঁয়াজ থাকে তখন। এই সময়ে তারা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার ও দাম বাড়ায়।
স্থায়ী সমাধান কোন পথে?
ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার মনে করেন, দেশের বাৎসরিক চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন। এর পুরোটাই দেশীয় উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব।
তার মতে— বছরজুড়ে পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলে কৃষক সঠিক দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে। এতে দেশেই বছরে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
উদাহরণ এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদার প্রায় পুরোটা উৎপাদন করা হয়েছিল। কিন্তু ঝুঁকি এড়াতে সে বছরও ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ফলে পেঁয়াজের যোগান হয়ে যায় চাহিদার চেয়ে বেশি। এতে বিপুল পরিমাণ দেশীয় ও আমদানি পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।
সেবছর দেশীয় পেঁয়াজের দাম কম পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন অনেক কৃষক। ফলে পরের বছর অনেক কৃষক পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদনও কমে যায়।
তিনি বলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পেঁয়াজের দাম যদি নির্ধারণ করে দেওয়া গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। যেমন- মার্চ-এপ্রিলে ৫০ টাকা, জুন-জুলাইয়ে ৬০ টাকা ও বছরের শেষদিকে ৭০ টাকা— তাহলেই কৃষক নির্দিষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ ফলাতে উৎসাহিত হবে।
ড. মজুমদার মনে করেন, কৃষকের চাষাবাদের খরচ বিবেচনায় রেখে মিয়ানমারের মতোও পেঁয়াজের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি দাম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। যাতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কারণ লাভজনক হলে প্রতিবছরই কৃষকরা পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন, এতে ঘাটতিও কমে আসবে।
তবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতির ব্যবস্থা করা, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অন্য ফসলের সাথে পেঁয়াজ চাষ করতে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া, কৃষকদের জন্য ভালো ও উন্নত বীজ সরবরাহ করা করতে হবে। এতে কয়েক বছরের মধ্যেই পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যাবে। সূত্র: বিবিসি
এইউ