ঢাকার ধামরাইয়ের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মী রেশমা নাসরিন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তার বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি কিছুটা ক্ষীণ। ২০১৩ সালে যখন তিনি স্নাতকোত্তরের ছাত্রী সেসময় এক সন্ধ্যায় হঠাৎ আঁধার নেমে আসে তার চারদিকে। দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন বিভিন্ন হাসপাতালে।
অবশেষে মিরপুরের এক চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখালে তিনি বলেন, তার কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে। দ্রুত চিকিৎসা না করালে অন্য চোখেও এর প্রভাব পড়তে পারে। তিনি জানান, দেশে কর্নিয়া পাওয়া অনেকটা অসম্ভব। এর জন্য যেতে হবে ভারতে। সেখানে কর্নিয়াসহ চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে। আর এতে খরচ পড়বে প্রায় ৫ লাখ টাকা।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য বাবার পক্ষে এত টাকা যোগাড় করা তো সহজ কথা নয়। তাই পাসপোর্ট করেও বিদেশ যাত্রা পেছাতে থাকে। ফিকে হতে থাকে রেশমার চোখে আলো ফেরানোর স্বপ্ন।
এরই মধ্যে ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর টেলিভিশন স্ক্রলে এলো ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মৃত্যুসংবাদ। জানানো হলো ভাষাসৈনিকের মরণোত্তর দেহ ও চক্ষুদানের বিষয়টিও।

কর্নিয়ার জন্য সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিতে রেশমা আগেই নিবন্ধন করে রেখেছিলেন। ভাষা মতিনের চক্ষুদানের বিষয়টি জানার পরই দ্রুত সন্ধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। ঢাকায় আসার পর শুরু হয় অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি।
বিজ্ঞাপন
৯ অক্টোবর ২০১৪ ঢাকার সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে মাত্র পনেরো হাজার টাকা ব্যয়ে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের চোখের কর্নিয়া স্থাপিত হয় রেশমার চোখে। ফলে ১০ অক্টোবরের সূর্যটা সত্যি সত্যি রেশমার চোখের আঁধার সরিয়ে আলোর সুষমায় পরিপূর্ণ করে দেয়। এদিনের সকালটা ছিলো ভীষণ উদ্দীপনার, আত্মতৃপ্তির, গৌরবের।
সেদিনের স্মৃতি মনে করে রেশমা ঢাকা মেইলকে বলেন, যে চোখ বায়ান্ন দেখেছিল সে চোখে আমি এখনো একুশ দেখে চলেছি। এমন একজন মহান ব্যক্তির চোখে দুনিয়া দেখছি বলে নিজেকে সত্যিই বড় সৌভাগ্যবান মনে হয়। সবসময় তার কথা ভাবি। তার জন্য দোয়া করি।
আরো পড়ুন: বিয়ে বাদ দিয়ে ভাষার দাবিতে মিছিলে গিয়েছিলেন শহীদ রফিক
তিনি আরও বলেন, এখন আমার ভীষণ গর্ব হয়, নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়, আমার শরীরে বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বহমান এবং আমি পৃথিবী দেখি একজন ভাষাসৈনিকের কর্নিয়ায়।
রেশমা জানান, আমার চোখে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের কর্নিয়া স্থাপনের পর থেকেই আমি তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু আমি তাদের খুঁজে পাইনি। প্রায় সাড়ে সাত বছর অপেক্ষা করার পর গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরার বাসায় আমি ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের পরিবাবের সঙ্গে দেখা করেছি উনারা সবাই অনেক আন্তরিক এবং অনেক ভালো মনের মানুষ। আমি তাদের প্রত্যেকের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।
শুধু চোখের আলোয় ভেসে যাওয়া নয়, ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের আদর্শও ধারণ করতে চান রেশমা। তাই তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মরণোত্তর চক্ষু দান করবেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আজ উনার (ভাষা মতিন) দান করা চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখে আমিও অনুপ্রাণিত হচ্ছি। একজনের দান করা চোখে আরেকজন যদি দুনিয়ার আলো দেখতে পারে তবে এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। যদি আমার ডান চোখটা ভালো থাকে তবে ইনশাআল্লাহ আমি সেটি দান করে যাবো।
দুই সন্তানের জননী রেশমা ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার সুয়াপুর ইউনিয়নের ঈশাণনগর গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের ‘হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার’ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি একই ইউনিয়নের শিয়ালকুল এলাকায় তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুল বারেক।
বর্তমানে তিনি দশম শ্রেণি পড়ুয়া বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মীম (১৫) এবং ছোট ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ রাইয়ানকে (৫) নিয়ে স্বামী আব্বাস আলীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলাধীন চর আজিমপুর গ্রামে বসবাস করছেন। সেখান থেকেই নিত্য দিন পাড়ি দিচ্ছেন আপন কর্মক্ষেত্রে।
প্রতিনিধি/টিবি/একেবি