মাকে মা ডাকবে বলে, স্বাধীন সুর তুলবে বলে রমনার পিচ ঢালা প্রান্তরে ঢেলে দিলো নিজে বুকের রক্ত। জয় করে নিলো নিজের অজান্তে বাঙালির মন ও প্রাণ। তিনি হলেন বাংলা ভাষার জন্য প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন।
মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামে ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিনের বাড়ি। তার জন্ম ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর। মা রাফেজা খাতুন। শিশুকাল থেকে রফিক উদ্দিন গ্রামের সবার কাছে ছিলেন প্রিয়। এতটাই প্রিয় ছিলেন যে সকালে মার বুক থেকে ঘুম ভাঙ্গার আগেই গ্রামের মা-বোনেরা তাকে কোলে নিতে তাদের বাড়িতে এসে বসে থাকতেন। গ্রামের ধুলাবলির মধ্যে সবার ভালোবাসায় বড় হয়ে উঠেছিলেন শহীদ রফিক উদ্দিন।
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন। সেলাই শিল্পে তিনি ছিলেন বেশ পারদর্শী। এলাকার মানুষের দুঃখ-কষ্টে সবসময় তিনি নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যেতেন। সে জন্য ছোট-বড় সবার কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মানুষ। তিনি ভালো বাসতেন দেশ এবং বাংলা ভাষাকে।
আরো পড়ুন: কেউ খোঁজ রাখে না ভাষাসৈনিক নন্দ দুলাল সাহার
রফিক উদ্দিনরা ৫ ভাই ও দুই বোন। এরমধ্যে সবার বড় ছিল রফিক উদ্দিন। ভাইদের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন শুধুমাত্র ছোট ভাই খোরশেদ আলম। এছাড়া রয়েছেন তার ভাতিজা ও ভাগ্নেরা।
রফিক উদ্দিনের বয়স যখন ৫ বছর তখন নিজ গ্রামের পারিল প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দেন তার বাবা আব্দুল লতিফ। রফিক ছিলেন বেশ চঞ্চল ও মেধাবী ছাত্র। সে জন্য শিক্ষকরা তাকে অনেক ভালোবাসতেন। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকাকালে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় হাত ভেঙ্গে যায়। এসময় তার বাবা কলকাতায় প্রেসের ব্যবসা করতেন। ছেলেকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান সেখানে। ভর্তি করে দেন মিত্র ইনস্টিটিউটে। সেখানে বেশ কিছুদিন থাকার পরে হাত ভলো হয়ে গেলে ফিরে আসেন নিজ গ্রামের ভালোবাসার মানুষেদের কাছে।
বিজ্ঞাপন
পাশের গ্রামের বায়রা হাইস্কুলে ভর্তি হন। হাইস্কুলের পাঠ চুকিয়ে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। প্রবেশিকা পাস করে ১৯৪৮ সালে দেবেন্দ্র কলেজের বদলি সনদ নিয়ে ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হয়। পরে তখনকার সরকার বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দু ভাষায় বাঙালিদের কথা বলতে বলে। নিজ ভাষা বাদ দিয়ে পাকিস্তান সরকারে মনগড়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। রফিক উদ্দিন প্রতিবাদ করে বলতেন, আমার মাকে মা বলে ডাকব, বাংলা ভাষায় কথা বলব। সে জন্য বাংলা ভাষার দাবির জন্য করতেন মিটিং-মিছিল, সমাবেশ।
১৯৫২ সালে রফিক উদ্দিনের বয়স ২৫ বছর। বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেন। একই গ্রামের নাসির উদ্দিনের মেয়ে রাহেলা বেগমের সঙ্গে। তার ডাক নাম ছিল পনুবিবি। তাদের পানচিনিও হয়েছিল। কলেজপড়ুয়া ছেলের বিয়ে দিতে প্রেস ছেড়ে বাড়ি এলেন রফিকের বাবা। বিয়েকে কেন্দ্র করে তখন রফিকের আত্মীয়স্বজনসহ পুরো গ্রামে চলছিল আনন্দের জোয়ার। কিছুদিন পরই বিয়ে।
তখন ভাষার দাবিতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সারাদেশ। বিয়ের আনন্দ বাদ দিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ছুটে যান ঢাকায়। যোগ দেন মিছিলে। রফিক উদ্দিন ছিলেন মিছিলের সবার সামনে। পাকিস্তানি পুলিশ সেই মিছিলে চালায় বৃষ্টির মতো গুলি। গুলি এসে লাগে রফিক উদ্দিনের মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। মাথার খুলি উড়ে মগজ বেরিয়ে আসে রফিক উদ্দিনের। ভাষার জন্য শহীদ হয়ে পিচ ঢালা রাস্তার উপর পড়ে রইলেন। ক্যামেরায় বন্দি করলেন সাংবাদিকরা। ছবি তোলার দায়ে সেই সাংবাদিক কারাবরণ করছিলেন।
খবর এলো মিছিলে গিয়ে মানিকগঞ্জের সন্তান রফিক উদ্দিন মারা গেছেন। মানিকগঞ্জবাসীর মনে নেমে আসে কালো মেঘ। কান্নায় যেন বুক ফেটে যায়। রফিক উদ্দিনের বাবা অজ্ঞান হয়ে যান। মাটিতে মাথা ঠুকিয়ে, বুক চাপড়িয়ে কান্না করেন মা। শোকের মাতম গ্রামজুড়ে। বাবা আর্তনাদ করেন- রফিক কোথায় গেলি, আমার বুকে আয়।
আরো পড়ুন: ফেব্রুয়ারি এলেই ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয় শহীদ মিনার!
রফিকের দুলাভাই কারফিউর রাতে সাহস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান লাশ খুঁজতে। শুনতে পারেন লাশ আছে হাসপাতালের মর্গে। সেখানে নিরাপত্তা কঠিন থাকায় লাশের কাছ যেতে পারেননি। রফিকের দেহ থেকে উদ্ধার করা কলম দেখালে তার দুলাভাই ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, এটাই রফিকের কলম। সে এই কলম দিয়ে লেখতো।
পরে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিক উদ্দিনকে সমাধিস্থ করা হয়।
দেশের গর্ব শহীদ রফিকের বাড়িতে যাওয়ার জন্য শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে মোটরসাকেল নিয়ে রওনা দেন এই প্রতিনিধি। গন্তব্য রফিক নগর।
১৯৫২ সালে রফিক উদ্দিনের ছোট ভাই খোরশেদ আলমের বয়স ছিল আড়াই বছর। বড় ভাই রফিকের কোনো স্মৃতিই তার মনে নাই। তবে বড় ভাইয়ের অনেক গল্প মায়ের কাছ থেকে শুনেছেন তিনি বলে জানান।
শহীদ রফিকের প্রতি সম্মান জানিয়ে পারিল গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গ্রস্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। গ্রামের নাম হয়েছে এখন ‘রফিক নগর’। প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি গ্রামবাসী রফিকের নামে তার বাড়িতে মেলার আয়োজন করে। মেলায় সারাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন। মেলাটি চলে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
প্রতিনিধি/এসএস/একেবি