কাশফুল, পরিষ্কার নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ৷ শব্দগুলো শুনলেই মনে আসে ঋতুর রানি শরতের নাম৷ বাংলার প্রকৃতিতে শরতের আবির্ভাব আবারও মুগ্ধ করেছে আমাদের৷ ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি৷'—এভাবেই বাঙালির সামনে শরতের সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তার মতোই শরতে মুগ্ধ বাংলার কবিকূল৷
মাটিতে নেমেছে মেঘের পাল/এসেছে সোহাগী শরৎকাল.../যদিও শরৎ বলছে আজ আমি আর নেই/তবুও তার সৌন্দর্য্য এখনও বিরাজমান... নদীকে অপরূপ সৌন্দর্যে অলঙ্কৃত করে তুলছে কাশফুল।
বিজ্ঞাপন
শরৎ মানেই নদীর তীরে কাশফুল৷ সময়ের বিবর্তনে গ্রামে-গঞ্জে কাশফুলের আধিক্য কমে গেলেও যমুনার চরে তার সৌন্দর্য এখনও মিশে আছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে যমুনা বিধৌত চরাঞ্চল। বছরের এই সময়টায় ধূধূ বালিয়ালি চরাঞ্চলে কাশফুলের শুভ্রতায় ছেয়ে গেছে। কাশফুল ফুটলেই বোঝা যায় ঋতুর পরিবর্তন। শরতের সৌন্দর্য।
এ সময় আকাশে ভাসতে থাকে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। কখনও দেখা যায় ঝকঝকে নীলাকাশে ছোপ ছোপ সাদা মেঘের ভেলা।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার দিঘলকান্দি চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, নদ-নদীর পাড়জুড়ে সাদা মেঘ যেন মাটি স্পর্শ করছে। বাতাসে ঢেউ তুলছে কাশফুল। নদ-নদীর দুই পাড়ের দীর্ঘ এলাকা শুধু কাশফুলের শুভ্রতা। এদিকে কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকেই ঘুরতে এসেছে নদীর পাড়ে। কাশফুলের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা যায় অনেককেই।
তেমনি শহরের এক ঘেয়েমী জীবনের ক্লান্তি দূর করতে এসেছেন শিক্ষার্থী নাদিয়া। তিনি মুঠোফোনে ছবি ও সেলফি তুলতে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
নাদিয়া বলেন, প্রতিবছর শরতে আমাদের এই নদীর পাড়ে প্রচুর কাশফুল ফোটে। কাশফুলের সাদা রঙে চারপাশ ছেয়ে যায়। চমৎকার লাগে দেখতে। নদীর পাড়ে অনেক লোকজন আসে ঘুরতে।
>> আরও পড়ুন : প্রকৃতিপ্রেমীদের মনটানে কাশফুল
বগুড়া শহরের কাটনার পাড়া থেকে বেড়াতে আসা সুমন ও শাম্মী দম্পতি জানান, মুগ্ধ হওয়ার মতো একটি জায়গা। শহর থেকে সারিয়াকান্দি এসে প্রেম যমুনার ঘাট থেকে নৌকায় বসে দিঘলকান্দি চড়ে পৌছে চড়ের বালিতে পা দিতেই কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় কঠিন মনটাও যেন নরম হয়ে আসে। খোলা বাতাসে কাশফুলের খেলা দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে।
রফিক ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, কাশফুল যেমন সৌন্দর্য বাড়ায়, তেমনি ফুল ঝড়ে যাওয়ার পর কাশফুলের ডগা সংগ্রহ করে ঝাড়ু তৈরি করা হয়। অনেকেই এগুলো কেটে নিয়ে যায়। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবেও এগুলো বিক্রি হচ্ছে।
কাশফুল প্রকৃতিপ্রেমীদের আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহেও ভূমিকা রাখছে। কাশফুল ঝরে গেলে এর ডাটা শুকিয়ে ছনের মতো ডাটায় পরিণত হয়। স্থানীয়ভাবে কাশফুলের গাছকে ‘ছন’ বলা হয়। এই কাশবন কেটে ফেলা হলেও প্রাকৃতিকভাবে আবারও জন্ম নেয়। স্থানীয়রা কাশবনের আগাছা সংগ্রহ করে গো-খাদ্য হিসেবে। তাছাড়া এই আগাছা বাজারেও বিক্রি করে বলেও জানা যায়।
>> আরও পড়ুন : বগুড়ায় জমে উঠেছে শীতের আগাম সবজি বাজার
ছনের তৈরি ঝাড়ুর চাহিদা ব্যাপক। দৃষ্টিনন্দন ঘর বা বৈঠকখানা তৈরিতে ছনের ব্যবহার করা যায়। চরের দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি নির্মাণেও ছন ব্যবহার করে থাকেন।
সারিয়াকান্দি প্রেম যমুনার ঘাটে বসে ছন দিয়ে ডালা, ঝুঁড়ি, বাস্কেটসহ হস্ত শিল্পের অসংখ্য উপকরণ তৈরি করতে দেখা যায় কয়েকজন নারীকে। তারা জানান, সংসারের কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য তারা এ কাজ করে থাকেন।
নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে ছন দিয়ে হস্তশিল্প জাতীয় পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলো। পরে নারীরা এসব সামগ্রী তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। এছাড়া ছনের তৈরি ডালা, ঝুঁড়ি, বাস্কেটসহ অন্যান্য পণ্য বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। যার কারণে ছনের বাণিজ্যিক চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মিত জীবনধারা অব্যাহত রেখে যেমন যমুনা চর থেকে ছন সংগ্রহ করা যায়, তেমনি পারিবারিক কাজের বিরতিতে নারীরা ছন দিয়ে পণ্য উৎপাদন করতে পারেন।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক দুলাল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন বলেন, প্রাকৃতিক ভাবে কাশবনের জন্ম হয়। এটি আবাদ করতে কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না, বাড়তি পরিচর্যা করতে হয় না। এগুলো কৃষকরা গো খাদ্য হিসেবে, ঘরের ছাউনি হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন। তবে আগের মতো গ্রামগঞ্জে কাশফুল দেখা যায় না। শুধু মাত্র যমুনার চর বা বিভিন্ন চরাঞ্চলে দেখা যায়।
প্রতিনিধি/এইচই