বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

অগ্নি নিরাপত্তাহীনতায় চট্টগ্রামের ১৯ আইসিডি

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

চট্টগ্রামে ১৯টি বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) রয়েছে। যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের হাতে। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে এসব আইসিডি পরিচালিত হচ্ছে কোনোরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। ফলে অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে প্রত্যেকটি আইসিডি। যেকোনো মুহুর্তে দাউ দাউ করে জ্বলতে পারে এসব আইসিডি। সম্প্রতি এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একাধিক কর্মকর্তা।

তারা জানান, ২০২২ সালের ৪ জুন সীতাকুন্ডে বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ৭২ ঘণ্টা চেষ্টার পর এই অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। এতে চরম মূল্য দিতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। এই অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের ১০ সদস্যসহ ৫১ জনের প্রাণহানী হয়। অগ্নিদগ্ধ হন আরও অন্তত দু’শ জন।


বিজ্ঞাপন


এরপর চট্টগ্রামের সবগুলো আইসিডির ফায়ার সেফটি প্ল্যান নিশ্চিতকরণ ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদারের উদ্যোগ নেয় ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু দীর্ঘ আড়াই বছর অতিবাহিত হলেও আইসিডিগুলোতে ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কিছুই হয়নি। ফলে এখনও অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে আইসিডিগুলো।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা আরও জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আইসিডিতে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি এলাকায় পরিচালিত কেডিএস লজিস্টিক কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এসময় ৩৫ কন্টেইনার তুলার বেল পুড়ে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

এর আগে ২০২৩ সালের ১৩ জুন রাত পৌনে নয়টার দিকে পতেঙ্গা ভারটেক্স কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই অগ্নিকাণ্ডেও কয়েকটি তুলার কন্টেইনার পুড়ে ভস্মিভূত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

এর আগে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর বেলা তিনটার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এসময় সেখানে রফতানির জন্য রাখা পাটের স্তুপে আগুন লাগে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।


বিজ্ঞাপন


 

অগ্নিকাণ্ডের কারণ

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পরিচালিত ১৯টি কন্টেইনার ডিপোর একটিতেও পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান। এমনকি কোনো রকম নিয়মনীতি ছাড়াই চলছে বেসরকারি আইসিডিগুলো।আইসিডি পরিচালনার অনুমোদনকারী সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের এদিকে কোনো নজর নেই। রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা কাস্টমসও তেমন খোঁজখবর রাখে না। ফলে যেনতেনভাবে চলছে আইসিডিগুলো। অন্তত অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে আইসিডিগুলো বাঁচানো গেলে দেশের সম্পদ রক্ষা পেত। বেঁচে যেত তাজা প্রাণ।

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের আইসিডিগুলোতে ফায়ার সেফটির বিষয়ে সরেজমিনে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি ডিপো সেফটি প্ল্যানের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ডিপোগুলো সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন করেনি।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি আইসিডিগুলোতে সার্বিক পরিস্থিতি নিরূপণে তিনটি টিম কাজ করছে। ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন, ফায়ার সেফটি নিশ্চিতকরণ ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা জোরদার করতে নির্দেশনা দিলেও বেশিরভাগ আইসিডি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

উপ-সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, সীতাকুন্ডের ছয়টি কন্টেইনার ডিপোর মধ্যে তিনটিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট ও বিশেষ নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ নেই। ডিপোগুলো হলো: বে-লিঙ্ক, নেমসন কন্টেইনার ডিপো এবং পোর্টলিঙ্ক কন্টেইনার ডিপো। এছাড়া পোর্ট লিংক কন্টেইনার ডিপোতে গার্মেন্টসের কন্টেইনারের পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিকের কন্টেইনারও রাখা রয়েছে। ডিপো ব্যবস্থাপনায় রাসায়নিক ভর্তি কন্টেইনারগুলো অন্য কন্টেইনার থেকে আলাদা রাখতে হবে। এ জন্য দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। এ বিষয়ে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রামে ১৯টি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো রফতানি চালানের প্রায় শতভাগ ও ৩৮ ধরনের পণ্য আমদানি পরিচালনা করে থাকে। যার অধিকাংশই দাহ্য। এর মধ্যে রাখা হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থও। যা রাখার অনুমোদন নেই। এ বিষয়ে ডিপো কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ডিপোগুলোর ভেতর কী কী পণ্য রাখা আছে, কীভাবে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা হয়, নিরাপত্তাব্যবস্থা কী, সেসব খতিয়ে দেখার পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের লাইসেন্সসহ বিভিন্ন নথি ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যেসব ডিপোতে অগ্নিনিরাপত্তামূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই; তাদের সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

P1

উপ-পরিচালক বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগে কর্মরত শ্রমিকদের কমপক্ষে ১৮ শতাংশকে অগ্নিনির্বাপণ, জরুরি উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা এবং বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মধ্য থেকে অগ্নিনির্বাপণ দল, উদ্ধারকারী দল ও প্রাথমিক চিকিৎসা দল (প্রতিটি দলে ছয়জন করে) গঠন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান বলেন, বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, ফায়ার সেফটি প্ল্যান এবং ফায়ার হাইড্রেন্ট, ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন বা বাস্তবায়ন না করা ও লাইসেন্স ছাড়া পেট্রোল পাম্প পরিচালনাসহ বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়া গেছে। এ কারণে সম্প্রতি তিনটি কন্টেইনার ডিপোতে অভিযান চালিয়ে প্রতিটিকে ২ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অগ্নিদুর্ঘটনা কমাতে ডিপো কর্তৃপক্ষদের ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়নেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মানা হচ্ছে না অনুমোদিত নীতিমালা

চট্টগ্রাম বন্দরে আসা চাল, ডাল, ছোলা, গমসহ ৩৮টি আমদানি পণ্য খালাসের কার্যক্রম এবং রফতানি কন্টেইনারের প্রায় শতভাগই নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি আইসিডিগুলো। বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ২৯ বছর চেষ্টার পরও বেসরকারি আইসিডির জন্য দায়িত্বশীলরা চূড়ান্ত করতে পারেননি কোনো নীতিমালা।

২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে খসড়া নীতিমালা পাঠালেও তা আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে। নীতিমালা না থাকায় চট্টগ্রামে যে যার মতো করে গড়ে তুলছে একের পর এক আইসিডি। অথচ তৈরি থাকা ১৯টি আইসিডিতে এখনই প্রতি মাসে ২০ ফুট দীর্ঘ ৫৮ হাজার ৫০০ রফতানি কন্টেইনার ও ৩৪ হাজার ২০০ আমদানি কন্টেইনার হ্যান্ডেল করার সক্ষমতা আছে। সেক্ষেত্রে তারা প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার ৫০০ টিইইউএস রফতানি কন্টেইনার ও ৬ হাজার ৫০০ টিইইউএস আমদানি কন্টেইনার হ্যান্ডেল করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) হাবিবুর রহমান বলেন, পণ্য খালাস আর জাহাজীকরণের ঝামেলা এড়িয়ে বন্দরের ওপর চাপ কমাতে ১৯৯৫ সালে কার্যক্রম শুরু হয় আইসিডির। এই নীতিমালায় বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নতুন আইসিডি স্থাপন, শহরে থাকা বর্তমান

আইসিডিগুলোর সম্প্রসারণ না করাসহ ১৮টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে এ খসড়া পাঠানো হলেও এ পর্যন্ত তার চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি। এই সুযোগে বন্দরের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে আইসিডি নির্মিত হয়েছে। এগুলো হলো: এছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চিটাগাং কন্টেইনার লিমিটেড, কিউএনএস কন্টেইনার সার্ভিস লিমিটেড, ট্রান্স কন্টেইনার লিমিটেড ও কেঅ্যান্ডটি লজিস্টিক লিমিটেড, সি ফার লিমিটেড, ফিসকো বাংলাদেশ লিমিটেড ও সামিট এলিয়েন্স পোর্ট লিমিটেড।

৬ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ওশান কন্টেইনার লিমিটেড, গোল্ডেন কন্টেইনার লিমিটেড, শফি মোটরস ও ইনকনট্রেড লিমিটেড। বন্দরের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে আছে নতুন নির্মিত হওয়া আইসিডি ইনকনট্রেড লিমিটেড ও গোল্ডেন কনটেইনার লিমিটেডও। অন্যান্য আইসিডিগুলোর মধ্যে ইকবাল এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট লিংক লজিস্টিক সেন্টার লিমিটেড ও কেডিএস লজিস্টিক লিমিটেড যথাক্রমে ১৪, ১৫ ও ১৯ কিলোমিটার দূরে নির্মিত হয়েছে।

এদিকে নীতিমালা না থাকায় আইসিডির উদ্যোক্তারাও মান রক্ষার ব্যাপারে মনোযোগ দিচ্ছেন কম। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও যৌথ বাহিনীর একটি সমন্বিত দল ওয়ান ইলেভেনের সময় একবার সব আইসিডি পরিদর্শন করেন। তখনকার ১২টি বেসরকারি আইসিডি পরিদর্শন শেষে তারা ‘একটি আইসিডিও পণ্য রাখার জন্য শতভাগ উপযোগী নয়’ বলে মন্তব্য করেন।

তারা জানান, পোর্টলিংক ও সিসিটিএল ইউনিট-২ পণ্যাগারে শেড না থাকায় খোলা মাঠে আমদানি-রফতানি পণ্য স্টাফিং ও আনস্টাফিং করতে হয়। এছাক ব্রাদার্স, সিসিটিএল এক ও দুই নম্বর ইউনিট এবং শফি মোটরসে পরিকল্পনা অনুযায়ী নর্দমা নেই। আবার অনেকে সীমানা প্রাচীর তৈরি না করে শুধু কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে।

যেমন কেঅ্যান্ডটি লজিস্টিকস লিমিটেডের পূর্ব পাশে সীমানা প্রাচীর নেই। শুধু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এই পণ্যাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওশান কন্টেইনার লিমিটেড, ফিসকো বাংলাদেশ লিমিটেড, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (পশ্চিম) এবং কিউএনএস এই চারটির সীমানা প্রাচীর নিরাপদ ছিল না। আবার অধিকাংশ পণ্যাগারে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা নেই বলেও জানিয়েছিল তখনকার পরিদর্শক টিম।

এসব সমস্যা সমাধান করতে তখন বেসরকারি অভ্যন্তরীণ পণ্যাগার মালিক সমিতিকে (পিকডা) এক মাসের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিল তখনকার পরিদর্শক দল। পিকডার দাবি, এসব সমস্যা তারা পর্যায়ক্রমে সমাধান করেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনও অরক্ষিত অবস্থায় আছে বেশিরভাগ আইসিডি। এগুলো থেকে নিয়মিত পণ্য চুরি হচ্ছে। আবার নষ্ট হচ্ছে পণ্যের গুণগতমানও।

 

নেই কোনো স্ক্যানার

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রফতানি হওয়া পোশাক পণ্যের ব্যবস্থাপনা করে চট্টগ্রামের বেসরকারি আইসিডিগুলো। নীতিমালা অনুযায়ী ডিপোতে স্ক্যানার মেশিন বসানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানছে না কেউই। ফলে রফতানির আড়ালে অবাধেই পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

ডিপোগুলোতে স্ক্যানার না থাকা, ডিপো মালিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমঝোতার অভাব, অসাধু সিএন্ডএফ এজেন্টদের সহযোগিতা, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি এবং কাজের চাপে কাস্টমসের গাফিলতি থাকার কারণেই বিদেশে অর্থ পাচারের সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হাসমত আলী অর্থ পাচারের জন্য ডিপোতে স্ক্যানার না থাকাকেই বড় কারণ বলে মনে করছেন।

তিনি বলেন, পণ্য রফতানি প্রক্রিয়াকরণের অধিকাংশ কাজ ডিপোতে হয়। তাই সেখানে স্ক্যানার মেশিন বসানো অতি জরুরি। অথচ ডিপো মালিকরা সেদিকে কোন নজর দিচ্ছেন না। পাশাপাশি বন্দরে স্ক্যানার সংকট রয়েছে। তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা নানাদিক বিবেচনা করে চট্টগ্রাম বন্দরকে অর্থ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন।

তিনি আরও বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও সিএন্ডএফ এজেন্ট মিলে অর্থ পাচারে লিপ্ত হয়েছে। অতি সম্প্রতি আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। গত আড়াই বছরে ৪২৪টি চালানে পোশাক পণ্য রফতানির আড়ালে ১৪৭ কোটি টাকা দুবাইতে পাচার হয়েছে। আমরা কোন কোন সিএন্ডঅ্যাফ এজেন্ট জড়িত রয়েছে তা দেখছি। পাশাপাশি বিষয়টি তদন্ত করে মানি লন্ডারিং আইনে আলাদা আলাদা মামলা করা হবে। তবে এ ধরনের কাজ বার বার হতে দেওয়া যাবে না।

অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হাসমত আলী বলেন, বন্দরে স্ক্যানার মেশিনের সংকট বেশ পুরনো। তবে ডিপোগুলোতে স্ক্যানার মেশিন বসানো হলে পণ্য ও পণ্যের পরিমাণ সম্পর্কে পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হতো। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকলে অর্থ পাচারের প্রবণতাও কমে যেতো। তবে বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও ডিপো মালিকরা বিষয়টি আমলে নেননি।

২০১৭ সালে তৎকালীন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বেসরকারি ডিপোগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে ইয়ার্ড সম্প্রসারণ ও স্ক্যানার মেশিন বসানোর তাগিদ দিয়েছিলেন। বছরের পর বছর গড়ালেও সেদিকে নজর দেননি ডিপো মালিকরা।

সম্প্রতি পোশাক রফতানির আড়ালে আড়াই বছরে পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে তথ্য দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সে প্রতিবেদনে ঢাকা-চট্টগ্রামের ১৯টি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ১৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

P3

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দার এক কর্মকর্তা জানান, অর্থ পাচারের পেছনে কাস্টমসেরও দায় রয়েছে। আইন অনুযায়ী পণ্য কন্টেইনারে ঢোকার পর তা জাহাজে ওঠার আগে যাচাই করার ক্ষমতা একমাত্র কাস্টমসের রয়েছে। কিন্তু রফতানি পণ্য যথাসময়ে জাহাজে তুলতে ও কাজের চাপ থাকলে অনেক সময় তারা কন্টেইনারে থাকা পণ্য যাচাই করে দেখে না। ফলে অর্থ পাচারের সুযোগটা তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য স্ক্যান হয়েই জাহাজে উঠে। স্ক্যানার বসিয়ে কাজ চালু করলে কয়েকটি ডিপো ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

ডিপো নীতিমালার বিষয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, একটা স্ক্যানার কিনতে ১৫ কোটি টাকা লাগবে। আমি খরচ করলাম, কিন্তু এ টাকা আমি কার কাছ থেকে তুলবো। তখন একটা সমস্যা তৈরি হবে। বড় ডিপোগুলো ৪৫ একর জায়গার উপর অবস্থিত। কিন্তু অধিকাংশ ডিপো ১০-১৫ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে। এগুলোতে স্ক্যানার বসলে যানজট বাড়বে, কাজের গতি কমবে।

তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি আইন অনুযায়ী, ডিপোতে স্ক্যানার মেশিন বসানোর বিধান রয়েছে। কাজেই ডিপাগুলোতে স্ক্যানার মেশিন বসালে কাস্টমস গোয়েন্দা বা অন্যান্য কর্মকর্তারা বেসিক ধারণা থেকে পণ্যগুলো যাচাই করে নিতে পারতেন।

পোশাক কারখানা মালিকদের অর্থ পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, পণ্যের কম মূল্য দেখিয়ে কোন ব্যবসায়ী অর্থ পাচারে লিপ্ত থাকলে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবে নিরাপত্তার খাতিরে ডিপোতে স্ক্যানার বসালে কাজের গতি কমে যাবে। এতে করে সময়ক্ষেপণ হবে এবং আমরা ক্রেতা হারাবো। কাজেই সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সবদিক বিবেচনা করে নিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইসিডিএ) সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন শিকদার বলেন, নীতিমালা ছাড়া আইসিডি ব্যবসা চলায় এখন হুমকির মুখে আছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। তবে সার্বিক অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ চলমান রয়েছে। যেসব ডিপোতে ফায়ার রিজার্ভার নেই, সেসব ডিপোগুলো রিজার্ভার স্থাপন করবে। যেসব ডিপো হাইড্রোজেন পার অক্সাইডসহ বিপজ্জনক কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে আইএমডিজি কোড অনুসরণ করছে না, সেসব ডিপোর লাইসেন্স বাতিলসহ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে কাস্টমস।

প্রতিনিধি/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর