শীতে কুমড়া বড়ি ছাড়া যেন তরকারির স্বাদ পূর্ণতা পায় না। গ্রামাঞ্চলে এ মৌসুমে কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। চালকুমড়া আর মাসকলাইয়ের ডাল দিয়ে তৈরি এ কুমড়া বড়ির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। গ্রাম থেকে শহরেও পৌঁছে গেছে মুখরোচক সুস্বাদু এই খাবার। শীতকালে ভোজন প্রিয় মানুষের খাবারের তালিকায় থাকতেই হবে কুমড়া বড়ি।
চাহিদা থাকায় নাটোরের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে কুমড়া বড়ি তৈরি হচ্ছে। ফলে শত শত নারীরা এ কুমড়া বড়ি বানিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। গ্রামে গ্রামে বাড়ছে এর উৎপাদন।
বিজ্ঞাপন
নাটোরে তৈরি এসব কুমড়া বড়ি অনেকে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পাঠান। গন্ধ ও স্বাদ ভালো হওয়ায় দিনে দিনে বাড়ছে এ খাবারের জনপ্রিয়তা। ফলে নওগাঁ, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে এ বড়ি।
![]()
সরেজমিনে দেখা যায়, নাটোর শহরের তেবাড়িয়া, মল্লিকহাটি, পালপাড়া, বেলঘড়িয়া এলাকায় নারীরা বাড়িতে কুমড়া বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বাঁশের মাচায় জাল ও নেট পেড়ে তার ওপর তেল মাখিয়ে কুমড়া বড়ির সারি সারি বসিয়ে রোদ্রে শুকানো হচ্ছে। এসব কাজে বাড়ির নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও সাহায্য করছেন। কুমড়া বড়ির ঘ্রাণ জানান দিচ্ছে তার স্বাদ কেমন। পুরো শীত মৌসুমে চলে এ বড়ি বানানোর কাজ।
![]()
বিজ্ঞাপন
মাষকলাই ডাল ৬/৭ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর ডাল থেকে খোসা ছাড়িয়ে পাটায় মিহি করে পিষে নিতে হয়। পাকা চালকুমড়া কুচি কুচি করে কেটে, মোউরি, কালিজিরা, জিরা আর পানি একত্রে মিশিয়ে ২০/৩০ মিনিট ভালোভাবে বেটে নিতে হয়। তারপর মাচায় পাতলা নেট বা জালে তৈল মাখিয়ে হাতের সাহায্যে সারি সারিভাবে এক একটি বড়ি বসিয়ে রোদ্রে ২/৩ দিন শুকিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু এ কুমড়া বড়ি। এক কেজি কালাই ডালে ৫০০-৫৫০ গ্রাম ভালো মানের কুমড়া বড়ি তৈরি হয়ে থাকে। এসব শুকনা বড়ি ৪০০-৫০০ টাকা কেজি দরে হাটে-বাজারে বিক্রি হয়। তবে ভালো মানের বড়ি নিতে আগে থেকেই কারিগড়দের অর্ডার করতে হয়।
![]()
পালপাড়ার কারিগর চন্দ্রনা বলেন, শীত এলে কুমড়া বড়ি তৈরি শুরু হয়। ৪/৫ মাস পর্যন্ত চলে বড়ি তৈরির কাজ। এসব বড়ি তরকারিতে বাড়তি স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। এ বড়ি তৈরিতে অনেক সময় ও পরিশ্রম হয়। কালাই যত ফেটা যাবে বড়ি খেতে তত স্বাদ হবে এবং তরকারিতে বড়ি ফুলে। আমরা প্রতি কেজি বড়ি ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি করছি। অনেকে কিনে আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠান। আমাদের বড়ি একেবারে ফ্রেশ, ফলে এর চাহিদাও অনেক।
![]()
তেবাড়িয়া এলাকার কারিগর নিখিল কুমার বলেন, পুরো শীত মৌসুমে একদিন পর পর এ বড়ি বানিয়ে থাকি। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে কুমড়া বড়ি তৈরি করছি। গরম মৌসুমে এ চাহিদা কম থাকলে শীতের সময়ে প্রচুর চাহিদা বাড়ে। দিনে ৭-৮ কেজি বড়ি বানাতে হয়। আমাদের এসব বড়ি হাট-বাজারে বিক্রি করি না, বাড়ি থেকে আমাদের ক্রেতারা নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়। লাভের টাকায় সংসারের খরচসহ অন্যন্যা চাহিদা পূরণ করি।
বড়ির কারিগর গৃহবধূ চম্পা রাণী বলেন, ১২ বছর ধরে কুমড়া বড়ি তৈরি করে আসছি। বড়ি মূলত মাষকলাই, পাকা চালকুমড়া, জিরা, কালোজিরা, মোউরি মিশিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি বড়ি ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি করছি। এ বড়ি তৈরি করতে অনেক সময় নষ্ট ও পরিশ্রমও হয়। প্রতি কেজি বড়িতে ৮০/১০০ টাকা লাভ থাকে। এতে নিজেদের সাংসারিক খরচ মেটাতে সহজ হয়।
![]()
বড়ি কিনতে আসা ক্রেতা জহির উদ্দিন বলেন, এখানকার বড়ি অনেক সুস্বাদু। আমি ৫ বছর থেকে এদের কাছ থেকে কুমড়া বড়ি কিনে খাই। বড়ির যে স্বাদ তা এদের বড়িতে পাই। রান্নার পর নরম এবং বড়ি ফুলে বড় হয়। গন্ধে তরকারির স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।
স্বপ্না খাতুন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, দিদির হাতের তৈরি বড়ি অনেক ভালো লাগে। অন্য জায়গার বড়িতে ময়দা, আটা মেশানো হয়। যে কারণে বড়ি খেতে ভালো লাগে না। এখানকার বড়ি শুধু কালাই ডাল, চালকুমড়া ও মসলা দিয়ে তৈরির কারণে আসল স্বাদ পাওয়া যায়। প্রতিবছর শীতে আমরা ৫ কেজি করে কিনে নিয়ে যাই। মাছের ঝোলের সঙ্গে খেতে ভালো লাগে। বাচ্চারা বেশ পছন্দ করে এ রান্না কুমড়া বড়ি।
প্রতিনিধি/এসএস

